চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

মুক্তিযোদ্ধা সাধন কুমার পালিত

নাজিরহাটে ১২ ডিসেম্বর থেকে ৩ দিন সম্মুখযুদ্ধ

জাহেদুল আলম, রাউজান

১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:০২ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশ স্বাধীন করার জন্য মাত্র ১৭ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন রাউজানের মুক্তিযোদ্ধা সাধন কুমার পালিত। তখন তিনি ছিলেন রাউজান আরআরএসি মডেল হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। যুদ্ধশেষে ১৬ ডিসেম্বর সকালে রাউজানের গহিরা স্কুলে এসে বিজয়ের পতাকা উড়ান মুক্তিযোদ্ধা এটিএম নুরুল আমিনের নেতৃত্বে।

মুক্তিযোদ্ধা সাধন পালিত পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত সুরেশ চন্দ্র পালিতের পুত্র। তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী পালিত। এ দম্পতি ২ পুত্রসন্তানের জনক। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল শরণার্থী হিসেবে ভারতের ত্রিপুরা চলে যাই। সেখানে বসে সবাই সংগঠিত হই। এরপর বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে অংশ নেই।

প্রথমে হরিনা ত্রিপুরা ইয়ুথ ক্যাম্পে ১৫ দিন থেকে প্রশিক্ষণের জন্য ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটোনা ক্যাম্পে চলে যাই। ১ মাস ৩৭ দিন ট্রেনিং নিয়ে পুনরায় হরিনা ট্রানজিট ক্যাম্পে চলে আসি। তখন শপথবাক্য পাঠ করে ভারতের বৈষ্ণবপুর হয়ে ফটিকছড়ি রাজবাড়ি হয়ে আসার পথে ধুরুং খাল পার হওয়ার সময় মিলিশিয়া-রাজাকার ও পাকবাহিনী যৌথভাবে আমাদের আক্রমণ করে। আমাদের গাইড ছিলেন অংশু মং মারমা। তিনি তখন ‘পাঠান পাঠান’ বলে ডাকতে শুরু করেন। তখন আমরা সবাই পজিশনে চলে যাই। এক পর্যায়ে তারা আমাদের লক্ষ্যে করে একের পর এক গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পজিশনে গিয়ে আমরাও গুলি ছুঁড়তে থাকি। ওইসময় আমরা এলাকা ত্যাগ করার পর আমাদের না পেয়ে পুরো এলাকার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। পরে আমরা দু’পাশের পাহাড় ভেদ করে অনেকটা পিছু হটে আমাদের গ্রুপের সবাই রাউজানের কচুপাড়ায় এসে মিলিত হই। এরপর ছোট ছোট কিছু অপারেশন করি। বড় অপারেশন করে হলদিয়া আমীর হাটে রাজাকার, মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ পরিচালনা করি। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ চালাই। এ অপারেশন করার সময় আমাদের অবস্থান ছিল সর্ত্তাখালের এম্বুশে। আমাদের এক গ্রুপ গুলিবর্ষণ করতে করতে সামনে চলে যায়। তখন রাজাকার ও পাক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন আমাদের তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। তারা হলেন পংকজ বড়–য়া, আবদুল মান্নান, সামশুল আলম। শহীদদের রশি দিয়ে বেঁধে ট্রাকে করে নিয়ে যায় রাউজান কলেজ মাঠে। শহীদদের তিনজনকে দু’দিন পর রাউজান কলেজ থেকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী দাশ পাড়ার পুকুর পাড়ে কবর দেয় পাকবাহিনী। আমীর হাটে যুদ্ধের ঘটনায় শত্রুবাহিনীর অনেকে মৃত্যুবরণ করে। পরে আমরা ওই এলাকা ত্যাগ করে আমাদের ক্যাম্প কচুপাড়ায় চলে যাই। তিনদিন পর আমাদের এদেশীয় রাজাকার আলবদররা পাকবাহিনীকে নিয়ে আমাদের উপর হামলা চালায়। সেখানে আমরা ৮০-৯০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। হামলার সময় প্রচ- গোলাগুলির মধ্যে আমরাও তাদের প্রতিরোধ করি। এখানে আমাদের জাফর নামের এক সহযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর ১২ জনের একটি গ্রুপ চলে যাই ফটিকছড়ি বিবিরহাট হাইস্কুলে। সেখানে অবস্থান নিলে ভারতীয় বাহিনীসহ যৌথবাহিনী কামানের গোলাবর্ষণ করে নাজিরহাটের দিকে। তখন আমরা যৌথবাহিনীসহ ধুরং খালে উত্তর পাড়ে অবস্থান নিই। পাকবাহিনী ছিল নাজিরহাটের কাছাকাছি। ১২ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনদিন সম্মুখযুদ্ধ হয়। তিনদিন অনবরত যুদ্ধে পাকবাহিনীর অনেকে মারা যায়। তখন ওদের দলটি পিছু হটে। তারা ১৫ ডিসেম্বর এলাকা ত্যাগ করে। ১৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা এটিএম নুরুল আমিনের নেতৃত্বে পায়ে হেঁটে চলে আসি রাউজানের গহিরা স্কুল মাঠে। সে সময় শুনি দেশ স্বাধীন হয়েছে। ওই স্কুল মাঠে ১৬ ডিসেম্বর এটিএম নুরুল আমিনের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়াই এবং সেখানে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া আমাদের সংবর্ধনা দেয় এলাকাবাসী। যুদ্ধকালীন সময় আমাদের কমান্ডার ছিলেন এডভোকেট আবু মো. হাশেম ও শওকত হাফিজ খান।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট