চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

বয়ামে শুয়ে বাঘ-শাবক, ফণা তুলে আছে গোখরা

বিএফআরআই বন্যপ্রাণী মিউজিয়াম

বয়ামে শুয়ে বাঘ-শাবক, ফণা তুলে আছে গোখরা

তাসনীম হাসান

২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

কাচের গোলাকার দুটি স্বচ্চ বয়াম। ভেতরে ফরমালডিহাইডের দ্রবণ। সেই তরলে ভেজা শরীর মেখে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে দুই বাঘ-শাবক। বন্ধ চোখ, গর্জনহীন মুখ-মনে হয় গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। এই ঘুম একদিনের নয়, টানা ২৬ বছরের। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্মের মাত্র তিনদিনের মাথায় মারা যায় শাবক দুটি। এরপর ওই বছরের ১৯ মে থেকে তাদের ঠিকানা হয়েছে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই) অবস্থিত বণ্যপ্রাণী মিউজিয়ামে।

 

তবে এই জাদুঘরে শুধু বাঘ-শাবকই নয়। কাচের বয়াম আর কাচবন্দী আলমারিতে সারি সারি সাজানো মৃত প্রাণীগুলো যেন একেকটি নীরব জীবনকথা। চারপাশে তাকের ভেতর ৭৪ প্রজাতির ১২০টি মৃত প্রাণীÑচিত্রা হরিণ, খইয়া গোখরো, গেছো ব্যাঙ, জলপাইরঙা কাছিম, শঙ্খিনী, পাতি দুধরাজ, ঘড়িয়ালের ডিম-কি নেই সেখানে। এ যেন কাচের ভেতর বন্দী এক টুকরো জঙ্গল, যেখানে সবাই পাশাপাশি থেকেও আলাদা, সবাই নীরব থেকেও কথা বলে।

 

চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কয়েক পা এগোলেই পাহাড়ে ঘেরা, সবুজে মোড়া বিএফআরআই প্রাঙ্গণ। সেই প্রকৃতির কোলে ১৯৭৮ সালে জন্ম নেয় এই জাদুঘর। ইনস্টিটিউটের বয়সের ভারে নুয়ে পড়ার প্রহর গোনা প্রশাসনিক ভবনের তৃতীয় তলার এক কোণায় এই জাদুঘরের অবস্থান। জাদুঘরের কাঠের দরজাটা খুলতেই যেন মনে হবে কোনো এক চিড়িয়াখানায় ঢুকে পরেছেন! ২০ বাই ১৫ হাতের ছোট্ট কক্ষটির ভেতরে চেনা-অচেনা প্রাণী-পাখির নীরব মেলা।

 

বাঘ শাবকের পাশেই আছে চিত্রা হরিণের বাচ্চাও। ১৯৯৭ সালের ১৬ মার্চ চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা থেকে আনা এই প্রাণীটি যেন স্থির হয়ে আছে বয়ামের ভেতরে। রয়েছে ১৯৯২ সালে মিরসরাই থেকে সংগ্রহ করা গুইসাপের বাচ্চাও। তার শরীর মনে করিয়ে দেয়Ñকীভাবে বাসস্থান ধ্বংস আর নগরায়ণ ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে ফাঁকা করে দিচ্ছে। পাখিদেরও আছে আলাদা এক জগৎÑলালবুক টিয়া, ময়না, ঝুঁটি শালিকের পাশে কালিম পাখি। জলাধার ভরাট আর বন উজাড়ের সঙ্গে সঙ্গে যাদের বাসস্থানও সরে যাচ্ছে মানুষের চোখের আড়ালে। সংরক্ষণ থেকে বাদ পড়েনি বনছাগলের বিষ্ঠা-শিং, হাতির পা, শুশুকের কংকাল, সজারুর কাঁটা থেকে পাখির বাসাও।

 

বিএফআরআই-এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এখানে পশু-পাখি সব কিছু সংরক্ষণ করা হয়েছে বিজ্ঞানসম্মত নিয়মে। দুই প্রক্রিয়ায় এটি করা হচ্ছে। এর মধ্যে কাচের বয়ামে ফরমালডিহাইড দ্রবণ; বছরে বছরে বদলানো হয় এই তরলÑযাতে মৃত শরীরগুলো ‘বেঁচে থাকার মতো’ থাকে। আর কিছু প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে ট্যাক্সিডার্মি উপায়ে। এই প্রক্রিয়াটি এমনই এক নিখুঁত কাজÑযেটির মাধ্যমে চামড়া সংগ্রহ করে সেটি নকল কাঠামোর ওপর বসিয়ে প্রাণীকে জীবন্তের মতো রূপ দেওয়া হয়। এই উপায়ে পদ্ম গোখরাকে এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যেন মনে হবে হাত বাড়ালেই ছোবল মারবে ফণা তুলে থাকা বিষধর সাপটি।

 

বিএফআরআই-এর জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ প্রাণীদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করার প্রয়াস থেকেই ১৯৭৮ সালে এই বন্যপ্রাণী জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মৃত পশু-প্রাণী সংগ্রহ করে এটিকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। দুই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এসব সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটিকে আরও বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে।’

 

এই জাদুঘর সবার জন্যই উন্মুক্ত। তবে প্রবেশের আগে বিএফআরআই-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছ থেকে একবার অনুমতি নিয়ে নিতে হবে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি গবেষণার কাজেও এখানে ভিড় জমান দেশের নানা প্রান্তের গবেষকরা।

 

৪৭ বছর আগে জন্ম নেওয়া এই জাদুঘর শুধু মৃতদের ঘর নয়Ñএ এক জীবনের পাঠশালাও। যেখানে বাঘ আর হরিণশাবকের নীরব দৃষ্টি সবাইকে দেয় ‘সতর্কবার্তা’। প্রকৃতিকে হারিয়ে দিলে একদিন বনে নয় পশু-পাখির দেখা মিলবে কেবল কাচের বয়ামেই!

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন