চট্টগ্রাম সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫

মশাবাহিত রোগের ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম!
ছবি: পূর্বকোণ

মশাবাহিত রোগের ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম!

নিজস্ব প্রতিবেদক

২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ আর মৌসুমি জ্বর শুধু সমস্যাই নয় বরং তা এখন জটিল, দীর্ঘমেয়াদি নগরীয় জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিতে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞগণ এই পরিস্থিতিকে ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে অর্ধশতাধিক জিনগত মিউটেশন শনাক্ত হয়েছে, যা পূর্বে পাকিস্তান, ভারত ও থাইল্যান্ড ও কেনিয়াতে পাওয়া গিয়েছিল। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এআরএফ)-এর যৌথ গবেষণায় এমনই তথ্য উঠে এসেছে।

 

গবেষকদের ভাষ্য, এই মিউটেশন ভবিষ্যৎ সংক্রমণের প্রকৃতি, তীব্রতা ও চিকিৎসা-প্রতিরোধে প্রভাব ফেলতে পারে। শুধু তাই নয়, মশাবাহিত এ ভাইরাসের সংক্রমণ নগরী ও আশপাশের উপজেলায় জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

 

গতকাল রবিবার দুপুরে নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি, ঝুঁকি, চিকিৎসা এবং ভাইরাসের জিনোমগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এই বিস্তৃত ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।

 

চলতি বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন উপজেলার রোগীদের ক্লিনিক্যাল, জনস্বাস্থ্য ও জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করা হয় এসপেরিয়া হেলথ কেয়ার লিমিটেডের সহযোগিতায় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের তত্ত্বাবধানে। এতে নগরীর ও আশপাশের উপজেলার ১ হাজার ১০০ জন চিকুনগুনিয়া এবং ১ হাজার ৭৯৭ জন ডেঙ্গু রোগীকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আদনান মান্নান, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দিন।

 

চিকুনগুনিয়া সংক্রান্ত গবেষণায় উঠে আসে সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র। গবেষণায় ওঠে আসে, এটি আর স্বল্পমেয়াদি জ্বর নয় বরং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা ও কর্মক্ষমতা হারানোর বড় কারণ হয়ে উঠছে। গবেষকদের হিসাবে, আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে গোড়ালি, হাঁটু, কব্জি ও হাতের অস্থিসন্ধিতে তীব্র ও স্থায়ী ব্যথা তিন মাসের বেশি সময় ধরে টিকে থাকে। অনেকের সকালে অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যাওয়া ও ফোলা ভাব অধিকাংশ রোগীরই নিয়মিত অভিজ্ঞতা ছিল। এতে স্বাভাবিক জীবনযাপন তো বটেই, কাজে ফেরা হয়ে উঠছে কঠিন।

 

গবেষক অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান বলেন, আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে গুরুতর আর্থ সামাজিক প্রভাব দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে- রোগীরা কমপক্ষে ৭-৮ দিন তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিলেন। চিকিৎসা ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ রোগীর জন্য ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। এছাড়া, আক্রান্তদের মধ্যে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ রোগী চিকিৎসা ও কাজের ক্ষতি পোষাতে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন।

 

গবেষণায় আরও দেখা যায়, চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে ১০ শতাংশ রোগীর শরীরে ডেঙ্গু এবং ১ দশমিক ১ শতাংশ রোগীর শরীরে জিকা সহ-সংক্রমণ পাওয়া গেছে। তিনটি ভাইরাস একসঙ্গে একই জনপদে সক্রিয় থাকায় চিকিৎসা ও রোগতাত্তি¡ক জটিলতা বাড়ছে। কোতোয়ালী, বাকলিয়া, ডবলমুরিং, চকবাজার, আগ্রাবাদ, হালিশহর ও পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এই সাতটি এলাকায় সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। উপজেলা পর্যায়ে সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালি ও আনোয়ারা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

 

ডেঙ্গুতে তরুণরা বেশি আক্রান্ত: ডেঙ্গু বিশ্লেষণে মোট ১ হাজার ৭৯৭ রোগীর তথ্য মূল্যায়নে দেখা যায়, প্রায় অর্ধেক রোগী সতর্কতামূলক লক্ষণসহ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং উল্লেখযোগ্য অংশ গুরুতর ডেঙ্গু পর্যায়ে পৌঁছান। ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীই জ¦রে ভুগছিলেন। আর ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ বমি ও বমিভাব, ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ মাথাব্যথা, ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ চোখের পেছনে ব্যথা, ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ মাংসপেশির ব্যথা, ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ পেটব্যথা ও ২৩ শতাংশ ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ বেশি দেখা গেছে।

 

জনসংখ্যাগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৮ থেকে ৩৫ বছরের তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। এ হার ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ। পুরুষের হার নারীদের তুলনায় বেশি। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও রক্তক্ষরণজনিত জটিলতা একাধিক রোগীর ক্ষেত্রে শনাক্ত হয়েছে। গবেষকদের মতে, ডেঙ্গু এখন কর্মক্ষম, শহরমুখী জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন ঝুঁকি।

 

গবেষকদের অভিমত, চিকুনগুনিয়াকে দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে সমন্বিত রোগ নিয়ন্ত্রণ, ক্লিনিক্যাল রিপোর্টিং, জিনোম ভিত্তিক নজরদারি এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। তাদের সতর্কতা চট্টগ্রামে ডেঙ্গু কেন্দ্রিক কৌশল যথেষ্ট নয়; বদলে যাওয়া ভাইরাস, দীর্ঘ ব্যথা এবং সহ-সংক্রমণ শহরের জন্য সম্ভাব্য নতুন মহামারির সংকেত।

 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ: গবেষকরা সতর্ক করেছেন চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে দ্রæত পদক্ষেপ জরুরি। তারা জানিয়েছেন, ভাইরাস পর্যবেক্ষণ শক্তিশালী করতে হবে, সংক্রমণের হটস্পট দ্রুত শনাক্ত করতে হবে, স্থানীয় পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। দ্রুত এবং স্বল্প খরচে ডায়াগনস্টিক কিট তৈরি ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, চিকিৎসা ও গাইডলাইন প্রমাণভিত্তিক হালনাগাদ করতে হবে, ভ্যাকসিন ট্রায়ালে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে, মশা নিয়ন্ত্রণ আধুনিকায়ন করতে হবে এবং জলবায়ু-সহনশীল নগর পরিকল্পনা কার্যকর করতে হবে। এছাড়া জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমানো এবং আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি। গবেষকরা জানিয়েছেন, এসব পদক্ষেপ ছাড়া সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় এবং মহামারী রূপ নেওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে না।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট