চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

মনির-আমিনের চোখে আলো ফিরলো প্রভাকরের ‘দানে’

মনির-আমিনের চোখে আলো ফিরলো প্রভাকরের ‘দানে’

তাসনীম হাসান

২৯ নভেম্বর, ২০২৫ | ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ

প্রভাকর বড়ুয়া; জীবনের শেষ প্রহরে দাঁড়িয়েও মানুষটা যেন আলো বিলিয়ে যেতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর বুকে। মৃত্যুর আগে সেই কথাই বলেছিলেন স্বজনদের, ‘আমার চোখ দুটো যদি কারও অন্ধকার ঘোচাতে পারে, তাই হবে আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি।’

 

কথা রেখেছে পরিবার। প্রভাকরের মৃত্যুতে তার পরিজনরা যখন শোকের নদীতে ভাসছেন, তখনই এক অলৌকিক যাত্রা শুরু হলো তার রেখে যাওয়া চোখের। ওই দুই চোখেই যে পৃথিবীর আলো দেখতে শুরু করেছেন দু’জন মানুষ। প্রভাকর বড়ুয়ার বাড়ি চন্দনাইশের কাঞ্চনগরে। অসুস্থ ছিলেন বহুদিন। কিছুদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একেবারেই শয্যাশায়ী। এক বছর আগে তার পুত্রবধূ মিতা বড়ুয়া শ্বশুরকে একটি মানবিকতার গল্প শোনান। তার এক আত্মীয় মৃত্যুর পর চক্ষুদান করে যান। সেই চোখে আলো ফিরে পান অন্যরা। গল্পটি বেশ মনে ধরে যায় প্রভাকরের; সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন দান করে যাবেন দুই চোখ। বারবার ছেলে সঞ্জীব বড়ুয়াকে সেই কথা মনে করিয়েও দেন প্রভাকর। ১৯ নভেম্বর ভোরে মারা যান প্রভাকর। পরে তার সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পরিবার সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিটকে চক্ষুদানের বিষয়টি জানায়।

 

খবর পেয়ে সন্ধানীর সদস্যরা দ্রুতই ঘটনাস্থলে পৌঁছে সফলতার সঙ্গে চোখের কর্নিয়া সংগ্রহ করেন। সেই কর্নিয়া পাঠানো হয় ঢাকার সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিতে। এরপর কর্নিয়া দুটি ঢাকার মনির আহমেদ খান ও সিরাজগঞ্জের মো. আল আমিনের চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়।

 

জন্ম থেকেই ডান চোখের আলো ক্ষীণ আল আমিনের। এরপর সেই আলো পুরোপুরি নিভে যায়। দু’বার কর্নিয়া প্রতিস্থাপনেও ফেরেনি আলো। এবার কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর ৪৪ বছরের আমিন চোখে দেখতে শুরু করেছেন।

 

আল আমিন বলেন, ‘সন্ধানীর উদ্যোগে চোখের কর্নিয়া পেলাম। বেশ ভালোভাবেই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এখন বেশ ভালো আছি।’ তবে আল আমিন জানতেন না কার চোখের কর্নিয়ায় ফিরে পেয়েছেন চোখের আলো। এখন সেটি জানতে পেরে প্রভাকরের জন্য করলেন দোয়া।

 

আরেকটি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মনির আহমেদ খানের চোখে। গতবছরের এপ্রিলে বাম চোখের ছানির অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে ‘ভুল’ চিকিৎসার শিকার হন ৬২ বছরের মানুষটি। ব্যথা না কমায় বারবার যান যার কাছে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন সেই চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু প্রতিবার তিনি শুধুই আশার বাণী শুনিয়ে যান।

 

এরইমধ্যে ডান চোখেও সমস্যা শুরু হয়। একপর্যায়ে আরেক চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি ভুল চিকিৎসার বিষয়টি ধরতে পেরে দ্রæত কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। পরে এক বন্ধুর সহযোগিতায় তিনি সন্ধানীর সন্ধান পান। সেখানে গিয়ে নিজের নাম নিবন্ধন করে আসেন বেশ কয়েকমাস আগে। এরপর অপেক্ষায় থাকেন সন্ধানীর ফোনের। অবশেষে ২০ নভেম্বর এলো তার জীবনের বহুল কাক্সিক্ষত সেই ডাক!

 

জানতে চাইলে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন মনির আহমেদ খান। বলেন, ‘বাম চোখ নিয়ে বহু কষ্ট পেয়েছি। এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে দৌড়েছি। পরে জানতে পারলাম কর্নিয়া প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনওভাবেই ফিরবে না চোখের আলো। সন্ধানীকে ধন্যবাদ, আমার জন্য কর্নিয়ার ব্যবস্থা করায়।’

 

মনির আহমেদ খান পরে জানতে পারেন যার কর্নিয়ায় তিনি এখন চোখে দেখছেন, সেই প্রভাকর তারই এক বন্ধুর আত্মীয়। এরপর থেকে মনের ভেতর একটি শপথ করে নেন তিনি। সেটি হলো- যতদিন বাঁচবেন মানুষের জন্য করে যাবেন কাজ। আর শিগগির আসবেন চট্টগ্রামে, প্রভাকরের কর্নিয়াতেই দেখে যাবেন তার স্বজনদের।

 

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, একমাত্র কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফেরানো সম্ভব। মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া সংগ্রহ আর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেটি প্রতিস্থাপন করতে হয়। দেশে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। তবে প্রভাকরের কর্নিয়া দু’জন মানুষ পেলেন একেবারেই বিনামূল্যে। তাদের শুধু অস্ত্রোপচারের খরচটাই হয়েছে।

 

সন্ধানী চট্টগ্রামের সভাপতি মিথিলা বনিক বলেন, ‘আমাদের দেশে কর্নিয়ার ব্যাপক সংকট রয়েছে। মানুষকে মরণোত্তর চক্ষুদানের বিষয়ে সচেতন করতে আমরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছি। সংক্রামক রোগ নেই- এমন যেকোন সুস্থ মানুষই মৃত্যুর পর চোখ দান করতে পারেন; শুধু একটি অঙ্গীকারপত্রই যথেষ্ট। বাকিটা আমরাই করবো।’

 

চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে প্রভাকার যেন রেখে গেলেন সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও; বৌদ্ধ ধর্মের মানুষটির কর্নিয়ায় আলো ফিরে পেলেন ইসলাম ধর্মের দু’জন মানুষ। পুত্রবধূ মিতা বড়ুয়ার কথাতেই ফুটে ওঠে প্রভাকরের আসল পরিচয়, ‘আমার শ্বশুর মানুষকে মানুষ হিসেবেই চিনতেন। কে কোন ধর্মের সেটি তার কাছে কখনও বড় কিছু ছিল না।’

 

মৃত্যুর পরও প্রভাকর বড়ুয়া যেন সৌহার্দ্যরে সেই আলো বিলিয়েই চলেছেন। প্রভাকরের চোখ এখন অন্য দু’জনের চোখে; আর তার মানবতা ছড়িয়ে যাচ্ছে আরও দূরে, আরও গভীরে। মৃত্যু যেন থামাতে পারেনি ৮০ বছরের মানুষটাকে; বরং করে তুলেছে চিরকালীন!

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট