
বাঁশখালীর বাহারছড়া ইউনিয়নে ২০১৫ সালে ভূগর্ভে পানির প্রাথমিক স্থিতিতল ছিল ৭১ ফুট। ১০ বছর পর চলতি বছরের আগস্ট মাসে পানির স্তর নেমে দাঁড়ায় ১৬২ ফুটে। বাহারছড়ায় প্রতি বছর নয় ফুট করে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। কাথারিয়া ইউনিয়নে ২০১৫ সালে পানির স্তরের স্থিতি ছিল ৭৭ ফুট। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে পানির স্তর গিয়ে দাঁড়ায় ৮৫ ফুটে। ইউনিয়নটিতে বিগত ১০ বছরে পানির স্তর ৮৫ ফুট নিচে নেমে যায়। প্রতি বছর সাড়ে আট ফুট করে পানির স্তর নিচে নামছে সেখানে। বাহারছড়া কিংবা কাথারিয়া নয়। পৌরসভাসহ বাঁশখালীর ১১ ইউনিয়নে প্রতি বছর আট ফুট পানির স্তর নিচে নামছে। বাঁশখালীর মতো একই অবস্থা চট্টগ্রাম জেলার ১৫ উপজেলায়। উপজেলাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির প্রাথমিক স্তর গড়ে কোথাও ৫০ কোথাও ৬০ আবার কোথাও ১০০ কিংবা ১৫০ ফুট পাওয়া গেলেও ৭০০ থেকে ৮৫০ ফুটের নিচে সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জেলার সাতটি উপজেলায় গত ১০ বছরে প্রায় ১০ হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে আছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, জেলার ১৫ উপজেলায় প্রতি বছর গড়ে আট ফুট করে সুপেয় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তবে ব্যতিক্রম সন্দ্বীপ উপজেলায়। সন্দ্বীপের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী রবিন সরকার জানান, সেখানে বিগত ১০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খুব একটা বেশি পরিবর্তন হয়নি। হতাশার বিষয় হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি স্থলভাগে প্রবেশের ঝুঁকি বাড়ছে। যদিও আশার কথা হচ্ছে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি রিচার্জ হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ক্যাচমেন্ট এরিয়া রয়েছে। এতে প্রতিবছর যে ভূগর্ভস্থর পানি রিচার্জ হচ্ছে তা উত্তোলণের তুলনায় বেশি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস জানান, ক্রমাগত সুপেয় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ কারণে ১৫ উপজেলায় অন্তত ৫০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভোগান্তি পোহাচ্ছে।
বাঁশখালীর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী সঞ্জীত চন্দ্র সরকার জানান, মাটি বোরিং না করা পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পানির স্তর পাওয়া যাবে তা বুঝা যায় না। বাঁশখালীতে সুপেয় পানির স্তর পেতে গড়ে সাত থেকে আটশ’ ফুট গভীরে যেতে হয়।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আয়শা আক্তার জানান, বিভিন্ন জায়গায় ঘনবসতি শুরু হয়ে গেছে। ভবনের হার অনেক বেশি হয়ে গেছে। বৃষ্টির পরিমাণটাও সময়মতো হচ্ছে না। সবমিলিয়ে পানির স্তরের উপর ইফেক্ট ফেলে। ইটভাটার কারণে সাতকানিয়ার কয়েকটি ইউনিয়নে পানির স্তর অস্বাভাবিকহারে নেমে যাওয়া প্রসঙ্গে ড. আয়শা আক্তার জানান, ইটের ভাটায় গভীর নলক‚প দিয়ে পানি উঠানোর কারণে ইটভাটার মৌসুমে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। বৃষ্টির পানি মাটির ভিতরে না গেলে তো আপনি পানি ওখান থেকে পাবেন না। এটাই মূল কারণ। কনক্রিটের আচ্ছাদন থাকলে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে গিয়ে স্টোর হতে পারে না।
পটিয়া: পটিয়া উপজেলার পটিয়া পৌরসভার পাঁচটি মৌজা অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এবং তিনটি মৌজা উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকার। উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের সাতটি মৌজা অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন, নয়টি ইউনিয়নের ২৭টি মৌজা উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা এবং আটটি ইউনিয়নের ৩০টি মৌজা মধ্যম পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।
প্রতিপালনীয় নির্দেশনা হলো- পানি সংকটাপন্ন এলাকায় বাংলাদেশ পানি আইন, ২০২৩ এর ধারা ৩ ও ১৮ অনুযায়ী পানি সম্পদের অগ্রাধিকার ভিত্তিক ব্যবহার যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। খাবার পানি ব্যতীত অন্য কোনো কারণে নতুন করে নলকূপ স্থাপন ও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং খাবার পানি সরবরাহ ছাড়া অন্য কোনো কারণে বিদ্যমান নলক‚পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ থাকবে। ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। খাল, বিল, পুকুর, নদী তথা কোনো জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না এবং জলাশয়গুলো জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। জনগণের ব্যবহারযোগ্য খাস জলাশয় ও জলমহালসমূহ ইজারা প্রদান নিরুৎসাহিত করতে হবে। জল¯্রােতের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘিœত করা যাবে না। কোনো জলাধারের সমগ্র পানি আহরণ করে নিঃশেষ করা যাবে না। ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতে পারে এমন কাজ করা যাবে না। নদী-জলাশয়-লেক-জলাভূমিতে বসতবাড়ি, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তরল ও কঠিন অপরিশোধিত বর্জ্য নির্গমন ও দূষণ করা যাবে না।
এছাড়া, অধিক পানি নির্ভর ফসল উৎপাদন নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে পানি সাশ্রয়ী ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে এবং জনসাধারণের সুপেয় পানি ও গৃহস্থালি কাজে পানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য নির্দেশনা প্রদান করা যাবে।
সাতকানিয়া: সাতকানিয়ার কেওচিয়া, ঢেমশা, নলুয়া কিংবা কালিয়াইশ ইউনিয়নে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ ফুট গভীরে গেলে প্রাথমিক পানির স্তর মিলে অনায়াসে। তবে সেই পানি পানযোগ্য নয়। সুপেয় পানি পেতে গড়ে ৮৫০ থেকে ৯৫০ ফুট গভীরে নলকূপের পাইপ স্থাপন করতে হয়। সাতকানিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিগত পাঁচ বছরে পৌরসভাসহ সাতকানিয়ার ১৭ উপজেলায় প্রায় ৬০০ নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। পুরানগড়, চরতী, এওচিয়া (আংশিক), কাঞ্চনা (আংশিক) ইউনিয়নের কিছু অংশে পানির পাম্প চালু করা হয়েছে। তবে অগভীর নলক‚প দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, সাতকানিয়ার শত শত ইটভাটায় ১০০ ফুট গভীরে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে। এতে ইটভাটার কাছাকাছি এলাকাগুলোতে পানির স্তর অস্বাভাবিকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে। বিগত পাঁচ বছরে সাতকানিয়ায় গড়ে সাত ফুট পানির স্তর নিচে নেমেছে।
সীতাকুণ্ড: পৌরসভাসহ সীতাকুণ্ডের নয়টি ইউনিয়নে ২৮ থেকে ৩০ ফুট গভীরে পানির প্রাথমিক স্তর পাওয়া যায়। তবে সুপেয় পানি পেতে হলে গড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ ফুট গভীরে পাইপ স্থাপন করতে হয়। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী প্রনবেশ মহাজন জানান, সীতাকুণ্ডে সরকারিভাবে গভীর নলক‚প রয়েছে ১৯৩১টি। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এসব নলক‚পে শুষ্ক মৌসুমে তিনমাস পানি উঠে না। পানি সংকট দূর করতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। পানি সংরক্ষণের সুবিধার্থে উপজেলার বিভিন্নস্থানে ৩০২৪টি পানির রিজার্ভার তৈরি করা হয়েছে। আরো ৮০টি রিজার্ভার তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।
প্রকৌশলী প্রনবেশ জানান, সীতাকুণ্ডে শিল্পায়নের কারণে জসনংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন তা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
রাউজান: পৌরসভাসহ রাউজানের ১৫ ইউনিয়নে গড়ে ৩০ ফুট গভীর পানির প্রাথমিক স্তর পাওয়া যায়। তবে সেই পানি পানযোগ্য নয়। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গত দশ বছরে গভীর আর অগভীরসহ ৬০০ এর বেশি নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে।
রাউজান উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. রহমত উল্লাহ জানান, রাউজানের একেক এলাকায় পানির স্তর একেক রকম। তবে সুপেয় পানি পেতে গড়ে ৫৫০ থেকে ৬০০ ফুট গভীরে নলকূপ স্থাপন করতে হয়। তবে পানিতে আয়রণের সমস্যা রয়েছে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও জলাশয় ভরাটের কারণে পানির স্তর নিচে নামছে। বিশেষ করে অগভীর নলকূপগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না।
পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আনোয়ারায় প্রায় ২৫০০ গভীর আর অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে বিগত ১৪ বছরে। মীরসরাইতে হিংগুলী, জোরাররগঞ্জ, মীরসরাই সদর, ওয়াদেপুর ও ইছাখালীতে পানির স্তর সবেচেয়ে বেশি নিচে। সেখানে গড়ে ৬০০ ফুটের নিচে সুপেয় পানির স্তর মিলে না।
চন্দনাইশ উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী ফরহাদ উদ্দিন জানান, পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বিগত সাত বছরে ৮৪টি টিউবওয়েল অকেজো হয়ে গেছে। সেচ ও মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে।
বোয়ালখালী উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সুদস্সী দেওয়ান জানান, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় উপজেলার অধিকাংশ শ্যালো টিউবওয়েল অকেজো হয়ে আছে। গত ছয় বছরে পানির স্তর নেমেছে ১২ ফুট। মিল কারখানা ও কৃষি সেচের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, বোতলজাত পানির কারখানা স্থাপন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনীয়া, সন্দ্বীপ, লোহাগাড়া ও কর্ণফুলী উপজেলায় সুপেয় পানি পেতে গড়ে ৬০০ থেকে ৮০০ ফুট গভীরে নলকূপ স্থাপন করতে হয়।
পূর্বকোণ/ইবনুর