
নগরের চকবাজার এলাকায় বিকেল হতেই চোখে পড়ে সড়ক ব্যবস্থাপনার ‘বিশৃঙ্খলার দৃশ্য’। যেখানে হাঁটার ফুটপাত নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে তা দখল করে আছে হকাররা। সন্ধ্যা হতেই দেখা যায় সারি সারি ভ্যানগাড়ি গাড়ি চলার সড়ক দখল করে ‘বাণিজ্য’ করছে। এবার পথচারী ও গাড়ি চলছে সড়ক মাঝপথ বরাবর। গাড়ি ছুটছে ইচ্ছেমতো। হাতের ইশারায় গাড়ি আসা-যাওয়ার সিগন্যাল দিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। সঙ্গে আছে আরও কয়েকজন সহকারী। তাও গাড়ির চাপ সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। চতুর্মুখী গাড়ির চাপে এলোমেলো ব্যবস্থাপনা। একদিকে গাড়ি ছুটলেও অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে যানজট। এতো গেল একটা সড়কের উদাহরণ। এ রকম আরও সড়কের উদাহরণ দেওয়া যায়।
স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছরেও আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি নগরে। বিভিন্ন সময়ে শুধুমাত্র সিগন্যাল বাতির পেছনে খরচ হয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। কখনও মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষা হয়নি। কোথাও যানজট হলে ট্রাফিক বিভাগের ভরসা রোড ডিভাইডার। নগরজুড়ে সড়কে দেখা মেলে রোড ডিভাইডারের বেষ্টনী। জোড়া তালি দিয়ে চলছে নগর ট্রাফিক ব্যবস্থা।
নগরের সড়কগুলোতে নেই কোন ট্রাফিক সাইন, পথচারী পারাপারের জেব্রা ক্রসিং। ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে ফুট ওভার ব্রিজ, নেই আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। আর তা অপারেটরের দায়িত্বে রয়েছে ট্রাফিক বিভাগ।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (ইলেকট্রিক) শাফকাত বিন আমিন জানান, ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি সংক্রান্ত কোন পরিকল্পনা আপাতত সিটি কর্পোরেশনের নেই। গত এক বছরে নগর ট্রাফিকের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত কোন চিঠিপত্রও আমরা পায়নি।
নগরের ৪৬ মোড়ে থাকা সড়ক বাতি ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কিছটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নগর উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সেবামূলক সংস্থার সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে ২০১২ সালে ২১টি মোড়ের সিগন্যাল বাতি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। সেই সময় প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে বাকি ২৫টি মোড়ের বাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে ২৫ মোড়ের সড়কবাতি কার্যকর থাকেনি। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে সিগন্যাল বাতির পেছনে খরচ হয়েছিলো প্রায় ১৪ কোটি টাকা। সমন্বয়হীনতার কারণে যা পরবর্তীতে কোন কাজে আসেনি।
এনালগ সিগন্যাল সিস্টেম: ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড.প্রকৌশলী স্বপন কুমার পালিতের নেতৃত্বে নগরের বিভিন্ন জংশনে ট্রাফিক সার্ভের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করা হয়। গবেষণা দলের সদস্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীম জানান, গবেষণা কার্যক্রমের মূল।
বিষয়বস্তু ছিল নগরের জংশনগুলোর সক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনাগুলো যাচাই করা এবং গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি আধুনিক ‘ডিজিটাল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রণয়ন করা হয়। সেই আলোকে শহরের গুরুত্বপূর্ণ ৫৩টি জংশন সার্ভে করে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।
নগর ট্রাফিকের দক্ষিণ জোনের উপ কমিশনার (ডিসি) লিয়াকত আলী জানান, ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি লাগানোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। সিগন্যাল বাতি, সড়কে মার্কিং করা, জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। কিন্ত বাস্তবায়ন হয় কম। সাধ্যের মধ্যে নগর ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি।
যেসব কারণে সড়ক অব্যবস্থাপনা:
জনসংখ্যার চাপে নগর দিন দিন বিস্তৃত হলেও সমন্বিত নগর পরিকল্পনার অভাবে সড়ক নেটওয়ার্ক সময়োপযোগী হয়নি। বহুতল ভবন, শপিংমল, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে কিন্তু পর্যাপ্ত পার্কিংয়ে জায়গা তৈরি হয়নি। রাস্তার পাশেই গাড়ি দাঁড় করানো হয়, যাতে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। আবার বিভিন্ন স্কুলে ছুটির সময় যানজট তৈরি হয়। সড়ক সরু হওয়ায় গাড়ির জটলা লেগে যায়।
পণ্যবাহী যান চলাচল : চট্টগ্রাম বন্দর, শিল্পাঞ্চল এবং কনটেইনার ডিপোতে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি চলাচল করে। নির্দিষ্ট সময় মেনে গাড়িগুলোর প্রবেশ ও প্রস্থান হয় না। ফলে দিনের বেলা পণ্যবাহী যানবাহন শহরের সড়কে ঢুকে যানজট আরও বাড়িয়ে দেয়।
রিকশা ও সিএনজির আধিপত্য : সড়কে বিপুল সংখ্যক রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। যার মধ্যে অনেকগুলোই ট্রাফিক নিয়ম মানে না। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে থেমে যাত্রী ওঠানামা করানো বা ইউ-টার্ন নেওয়ার কারণে যানবাহনের গতি ব্যাহত হয়। আবার নতুন করে মাথাব্যথা বাড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।
সড়কের সংকীর্ণতা ও অপর্যাপ্ততা : প্রধান সড়কগুলো যেমন আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাট, দুই নম্বর গেট, চকবাজার, টাইগারপাস এলাকায় সড়কের প্রস্থ তুলনামূলক কম। যানবাহনের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, অথচ নতুন বিকল্প সড়ক তৈরি হয়নি। ফ্লাইওভার নির্মাণ হলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক র্যাম্প তৈরি কিংবা প্রস্তত না হওয়ায় সুফল মিলছে না।
অবৈধ পার্কিং ও ফুটপাত দখল : যানজটের বড় কারণ অবৈধ পার্কিং। ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে মূল সড়কে হাঁটে, ফলে গাড়ির গতি ধীর হয়ে যায়। মাঝে মাঝে অভিযান চালানো হলেও তা টেকসই নয়।
গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা : বাস ও মিনিবাসগুলোতে শৃঙ্খলা নেই। যাত্রী ওঠানামার নির্দিষ্ট স্টপেজ মানা হয় না। যেখানে খুশি গাড়ি থামানো হয়, হেলপাররা যাত্রী ডাকাডাকি করে সময় নষ্ট করে। আবার অনেক চালক প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালায়, ফলে দুর্ঘটনা ও জট দুই-ই বাড়ে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা : ট্রাফিক পুলিশের সংকট এবং আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকায় যান চলাচল সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আবার অনেক চালক নিয়ম ভেঙে উল্টো পথে প্রবেশ করে, যা জটকে আরও জটিল করে তোলে।
প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতি : ট্রাফিক আইন প্রয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় প্রভাবশালীর গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আবার চালকেরা জরিমানা এড়াতে ঘুষ দিয়ে পার পেয়ে যান। এতে করে অনেকেই আইন মানে না।
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ