
কোনোটি ৭ দশমিক ৫ ফুট লম্বা আর দেড় ফুট চওড়া। কিছু আবার আরেকটু ছোট-দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৫ ফুট, চওড়া ওই দেড়ফুটই। দেখতে অনেকটাই চৌবাচ্চার মতো। একটা দুটো নয় চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল-শাহ আমানত সেতু সড়কের করমপাড়া মোড় থেকে চান্দগাঁও থানা পর্যন্ত প্রায় চারশ মিটার সড়কের দুই পাশে ফুটপাতের ওপর বসানো হয়েছে এমন কংক্রিট আর টাইলসে মোড়ানো ৮৫টি চৌবাচ্চা। শহরকে সুন্দর আর সবুজ করার পরিকল্পনায় ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে এগুলো তৈরি করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। কিছুদিনের মধ্যে মাটি ভরে গাছও লাগানো হয়েছিল সেগুলোতে। কিন্তু নিয়মিত পরিচর্যার অভাবে দ্রুতই শুকিয়ে মরে যায় বেশিরভাগ চৌবাচ্চার গাছ।
একই দৃশ্য বহদ্দারহাট-কালুরঘাট সড়কেও। সড়কটির বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম) কার্যালয় থেকে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার প্রবেশমুখ পর্যন্ত অর্ধকিলোমিটার সড়কের দুই পাশের ফুটপাতেও বসানো হয়েছে আরও প্রায় তিনশটি চৌবাচ্চা। যার মধ্যে প্রায় পৌনে তিনশটিতেই গাছ নেই-মরে গেছে অনেক আগেই।
গাছ নেই, পরিচ্ছন্নতাও নেই-ফলে বৃষ্টি হলেই খালি চৌবাচ্চাগুলো পানিতে টইটম্বুর করে। আর তাতে নিরাপদে ঘর বাঁধে মশার দল। শুধু তাই নয়, গাড়িচালক কিংবা পথচারীরা সুযোগ পেলে এসব চৌবাচ্চাকেই ব্যবহার করছেন প্রস্রাব-পায়খানার জায়গা হিসেবে। ফলে ফুটপাত ধরে হাঁটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রামে এবছর ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপও ছিল আশঙ্কাজনক। গত ১০ মাসে ৩ হাজার ৩৬৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে নগরীতেই ১ হাজার ৮০১ জন। মারা গেছেন ১৫ জন।
অন্যদিকে চিকুনগুনিয়াতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৬০জন। দুটি রোগের প্রধান কারণই মশা। অথচ গত জুনে বাসাবাড়িসহ কোথাও এডিস মশার প্রজননস্থল ও লার্ভা পাওয়া গেলে আর্থিক জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ড দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে নিয়মিত অভিযান চালানোর কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যে সংস্থা মানুষের বাড়ির ভেতর মশার লার্ভা খুঁজছে, তারা নিজেদের তৈরি চৌবাচ্চাগুলোর দিকে তাকাচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।
সরেজমিন:
গতকাল শুক্রবার বিকেলে করমপাড়া মোড় থেকে চান্দগাঁও থানা পর্যন্ত হেঁটে দেখা যায়, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে শাহ আমানত সেতু সড়কের পূর্ব পাশে সৌন্দর্যবর্ধনের গাছ রোপণের জন্য বসানো হয়েছে ১৯টি চৌবাচ্চা। তবে পশ্চিম পাশে বসানো হয়েছে তার তিনগুণেরও বেশি-৬৬টি। এর বেশিরভাগই থানার সীমানাদেয়ালের দুই পাশে। এসব চৌবাচ্চার বেশিরভাগেরই মরে গেছে গাছ। আর সেসব ভরে আছে আগাছা আর ময়লা-আবজর্নায়। পায়খানা-প্রস্রাবের উৎকট গন্ধে পথচারীরা হাঁটছিলেন নাক চেপে। সন্ধ্যা হলেই এসব চৌবাচ্চা ভরে যায় মশায়।
পাশের একটি ভবনের বাসিন্দা শিহাব উদ্দিন ময়লা-আবর্জনায় ভরে থাকা চৌবাচ্চাগুলো দেখিয়ে বলেন, ‘সন্ধ্যা হলেই বাসায় মশার জন্য বসা যায় না। দিনেও মশার যন্ত্রণায় থাকতে হয়। কোথায় মশা দূর করতে ব্যবস্থা নেবে। উল্টো এখানে যেন মশার জন্য ঘর বানিয়ে দেওয়া হলো।’
বহদ্দারহাট-কালুরঘাট সড়কের অবস্থাও একই। প্রায় তিনশটি চৌবাচ্চাতেই গাছ মরে গেছে। কিছু চৌবাচ্চা আবার দখল করে বসানো হয়েছে ভাসমান দোকান। তবে ব্যতিক্রম র্যাব-৭ এর বহদ্দারহাট ক্যাম্পের পাশের সাউদার্ন সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সামনের চৌবাচ্চাগুলো। সেখানে গাছগুলো আপন মনে বেড়ে উঠছে। ফিলিং স্টেশনের এক কর্মী বলেন, ‘দুই বছর আগে সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে এসব চৌবাচ্চা বসিয়ে গাছ রোপণ করা হয়। আমরা নিয়মিত আমাদের সামনের গাছগুলোর যত্ন নিই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করি। সে কারণেই গাছগুলো মরেনি।’
উল্টোপাশের সড়কের ফুটপাতের চৌবাচ্চাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। সেখানের সব চৌবাচ্চা নানারকম আগাছায় ভরা। পাশের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন রিকশাচালক আবদুল খালেক। তিনি একটা মশা মেরে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখলেন তো দিনেও বসা যাচ্ছে না। এরকম পরিবেশ হলে মশা তো জন্মাবেই।’
জানতে চাইলে চসিকের উপপ্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্মা পূর্বকোণকে বলেন, ‘চৌবাচ্চাগুলোতে দ্রুত নতুন গাছ লাগানো হবে। পাশাপাশি নিয়মিত পরিষ্কার এবং স্প্রে করা হবে, যাতে মশার প্রজননস্থল তৈরি না হয়।’
চসিকের এই কর্মকর্তার কথার দ্রুত বাস্তবায়ন চান ওই দুই এলাকার বাসিন্দারা। তারা বলেন, ‘শহরকে সুন্দর করার উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত যদি আমাদের জন্য নতুন সমস্যা তৈরি করে, তবে সেটা সৌন্দর্যবর্ধন নয়, অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। আমাদের প্রত্যাশা, দ্রুতই চৌবাচ্চাগুলো আবার সবুজ হবে-মশার ঘরবাড়ি নয়!’
পূর্বকোণ/ইবনুর