চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

স্তন ক্যান্সার : সর্বনাশের মূলে অসচেতনতা-অবহেলা
ফাইল ছবি

স্তন ক্যান্সার : সর্বনাশের মূলে অসচেতনতা-অবহেলা

ইমাম হোসাইন রাজু

১০ অক্টোবর, ২০২৫ | ৪:০০ অপরাহ্ণ

দীর্ঘদিন ধরে বুকের ব্যথাকে সাধারণ অসুখ ভেবে দিন পার করেছিলেন ৪২ বছর বয়সী শিরিন আক্তার। পরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল, মধ্যবয়সী এ নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। কিন্তু শনাক্ত হতে হতেই তার রোগ তৃতীয় ধাপে পৌঁছে যাওয়ায় দুরারোগ্য রোগ জটিল রূপ নিয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, অবহেলা না করে সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে রোগটি ধরা পড়তো। শিরিনের দ্রুত চিকিৎসা করা গেলে এই অবস্থা এড়ানো যেত।

 

এ চিত্র শুধুমাত্র শিরিন আক্তারের ক্ষেত্রেই নয়। তাঁর মতো চট্টগ্রামে এমন অসংখ্য নারী রয়েছেন, যারা দেরিতে রোগ ধরা পড়ায় জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- মধ্যবয়সী নারীদের ক্ষেত্রেই ঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন অবস্থায় নারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রাথমিক পরীক্ষার আওতায় আনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

 

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান বলছে, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন ৪০ থেকে ৫০ বছরের নারীরা। এ বয়সী রোগীর হার দাঁড়িয়েছে মোট শনাক্ত রোগীর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে। অন্যদিকে, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে এ হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রামে স্তন ক্যান্সার রোগীর হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। জাতীয়ভাবে প্রতি লাখ নারীতে যেখানে গড়ে ২২ জন আক্রান্ত হন, সেখানে চট্টগ্রামে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭৩ থেকে ৩৭২ জনে। অর্থাৎ জাতীয় গড়ের তুলনায় চট্টগ্রামে ১৫গুণ বেশি। চিকিৎসকদের ধারণা, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, স্থুলতা বৃদ্ধি, হরমোনজনিত সমস্যা ও পরিবেশগত প্রভাব এর জন্য দায়ী।

 

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামে রোগীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে। ২০২১ সালে শনাক্ত হয়েছিল আড়াই শতাধিক। আর ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২০০ জনে। এ প্রবণতা উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

চিকিৎসকরা জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে চিকিৎসা সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। প্রথম ধাপে রোগীর ৫ বছরের বাঁচার হার ৯০-৯৫%, দ্বিতীয় ধাপে ৭০-৮০%, কিন্তু তৃতীয় ধাপে তা নেমে আসে ৪০-৫০%-এ। আর চতুর্থ ধাপে বেঁচে থাকার হার মাত্র ২০-২৫%।

 

রোগী বাড়লেও চিকিৎসা সুবিধা সীমিত: চট্টগ্রামে বছরে বছর স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে এখনো চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা খুবই সীমিত। সরকারিভাবে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। বেসরকারিভাবে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে শল্যচিকিৎসা, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপি চালু রয়েছে। তবে রোগীর তুলনায় রেডিওথেরাপি মেশিনের সংখ্যা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

অবহেলায় বড় ঝুঁকি: সচেতনতার অভাবকেই নারীদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসকরা জানান, নারীরা সাধারণ ব্যথা কিংবা গিটকে অবহেলা করেন। অথচ নিয়মিত পরীক্ষা করালে ও সচেতন হলে প্রাথমিক ধাপেই রোগ ধরা সম্ভব।

 

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট ইনচার্জ ডা. ফারজানা ইউসুফ এ্যানি বলেন, আমাদের সমাজে নারীরা লজ্জা বা ভয় থেকে পরীক্ষা করাতে চান না। এটিই বড় বাধা। স্তন ক্যান্সার ভয় পাওয়ার বিষয় নয়। সময়মতো শনাক্ত হলে চিকিৎসা নিয়ে রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। কিন্তু অবহেলার কারণে অনেক রোগী ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।

 

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অ্যাডাল্ট আইসিইউ (অনকো-ক্রিটিক্যাল কেয়ার) ইনচার্জ ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেহেদি হাসান বলেন, চিকিৎসা নিতে আমাদের ইউনিটে আসা স্তন ক্যান্সার রোগীদের অনেকেই আসেন একদম শেষ পর্যায়ে। তখন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে, জটিলতা বাড়ে, আর রোগীকে বাঁচানো অনেক সময় সম্ভব হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু লক্ষণ থাকলেও তাঁরা গুরুত্ব দেননি বা সামাজিক কারণে পরীক্ষা করাতে চাননি। ক্যান্সার যত আগেভাগে শনাক্ত হয়, চিকিৎসা তত সহজ ও কার্যকর হয়। তাই নারীদের মধ্যে- ‘দেরি না করে চিকিৎসা নেওয়া’র সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

 

প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে স্তন ক্যান্সার পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য

ডা. শেফাতুজ্জাহান
পরিচালক, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট

 

ডা. শেফাতুজ্জাহান বলেন, আমাদের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের মধ্যবয়সী নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের হার সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ঝুঁকি উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। এ বয়সে অনেক নারী বুকের ব্যথা, গুটি বা অস্বাভাবিক পরিবর্তনকে সাধারণ অসুখ ভেবে অবহেলা করেন। ফলে চিকিৎসা নিতে দেরি হয়। দেরিতে রোগ ধরা পড়লে তা দ্রুত জটিল হয়ে পড়ে। এছাড়া জীবনযাত্রার পরিবর্তন, স্থূলতা, হরমোনজনিত সমস্যা, সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রবণতা কমে যাওয়ায় স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

 

তবে আশার কথা হলো- প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে স্তন ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। এজন্য নারীদের নিয়মিত স্ব-পরীক্ষা করতে হবে এবং সন্দেহজনক লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট