চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

বিশ্ব ডাক দিবস : চিঠি আসে না আর...

বিশ্ব ডাক দিবস : চিঠি আসে না আর…

মোহাম্মদ আলী

৯ অক্টোবর, ২০২৫ | ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

পোস্ট অফিসের চিঠিবাহক রানারের জীবন-যাপন নিয়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার বিখ্যাত রানার কবিতায় লিখেছিলেন, ‘রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে/ দস্যুর ভয়, তারও চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।’ কিন্তু মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ই-মেইল-ইন্টারনেটের যুগে রানারের সেই ব্যস্ততা এখন আর নেই। দুই যুগের ব্যবধানে কমে গেছে ডাকঘরের সেই রমরমা অবস্থা। কালের স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে বসেছে ডাক বিভাগ।

 

ডাক বিভাগের এ হাল অবস্থার মধ্যে আজ ৯ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডাক দিবস। ২০২৫ সালের বিশ্ব ডাক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘জনগণের জন্য ডাক : স্থানীয় পরিষেবা, বৈশ্বিক পরিসর’। এই প্রতিপাদ্যটির মাধ্যমে জনগণের জন্য ডাক পরিষেবাগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরা, স্থানীয় পরিষেবা ও বৈশ্বিক পরিসরে এর বিস্তৃতি বোঝানো এবং আধুনিক ডাক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

 

ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ) এই প্রতিপাদ্যের ওপর একটি বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রচারণায় সদস্য দেশগুলোকে অংশ নিতে আহ্বান করেছে। এর উদ্দেশ্য: জনগণের সাথে সরকারের সংযোগ বৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়নে ডাক সেবার ভূমিকা তুলে ধরা এবং ডাক ব্যবস্থার আধুনিকতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এই প্রতিপাদ্যের অন্যতম লক্ষ্য। ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৬৯ সাল থেকে বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়ে আসছে।

 

মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ই-মেইল-ইন্টারনেট প্রচলনের আগে গায়ের বধূ প্রবাসে থাকা তার স্বামীর পাঠানো পত্র পেতে ব্যাকুল হয়ে ডাকপিয়নের পথ চেয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতো। মনের মানুষের চিঠির অপেক্ষায় থাকতো তরুণ-তরুণী। বাড়ি থেকে দূরে কোন কর্মস্থলে থাকলে কিংবা প্রবাসে থাকা সন্তানের খবরের আশায় পত্রের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতো মা-বাবা। কিন্তু দুই যুগ আগের প্রিয়জনের সেই চিঠির আবেগময় আকুতি এখন আর নেই। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির ছোঁয়ায় ডাক বিভাগের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের আদান-প্রদান এখন নেই বললেই চলে। আগের মতো ডাক বিভাগের সেই জৌলস আর নেই।

 

ডাক বিভাগের চিঠি আদান-প্রদান প্রসঙ্গে নগরীর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মঈনুদ্দিন কাদের চৌধুরী লাভলু পূর্বকোণকে বলেন, ‘মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ই-মেইল-ইন্টারনেটের এ যুগে হাতে লেখা চিঠির প্রচলন নেই বললেই চলে। পত্র-মিতালির মতো মধুর বিষয়টি এখন পুরনো দিনের স্মৃতি। এমন একটা সময় ছিল যখন পত্রমিতালির মাধ্যমে সমমনা মানুষ কিংবা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সম্পর্কের ভিত রচিত হতো। চিঠির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতো নানা রকম সামাজিক সম্পর্ক। চিঠির মাধ্যমে অনুভব করা যেত মানুষের হৃদয়ের উত্তাপ, প্রীতি, ভালোবাসা, অনুরাগ কিংবা বিরাগের বিষয়টি। কিন্তু আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে চিঠিপত্রের আবেদন কমে যাওয়ায় দিনদিন ডাক বিভাগের আকর্ষণ হ্রাস পাচ্ছে। অথচ দুই যুগ আগেও চিঠি আদান-প্রদানের জন্য ডাকঘরে মানুষের ব্যাপক ভিড় থাকতো। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতেন ডাক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে মোবাইল ফোনের যাত্রার পর থেকে কমতে থাকে চিঠির আদান-প্রদান। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনের আরো প্রসার হলে ডাক বিভাগের সেই জমজমাট অবস্থা আরো কমতে থাকে।’

 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে। হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল) এএমপিএস মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকা শহরে প্রথম মোবাইল ফোন সেবা চালু করে। এরপর সারাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে। মূলত মোবাইল ফোনের যাত্রার পর থেকে ডাক বিভাগের রমরমা সেই জৌলস কমতে থাকে। এরপর সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও ডাক বিভাগের সেই রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। কাজ কমে যাওয়ায় ডাকঘরগুলোয় অনেকটা জনশূন্যতা বিরাজ করছে। নগরীর এক সময়ের কর্মব্যস্ত জিপিও’র অবস্থাও একই। আগের সেই কর্মচঞ্চল পরিবেশ নেই। লম্বা লাইন নেই মানুষের। হাতেগোনা মানুষ আসছে, কাজ সেরে চলে যাচ্ছে। একই অবস্থা অন্যান্য পোস্ট অফিসসমূহের। চিঠি আদান প্রদান অনেকটা নেই বললে চলে। তাই সাধারণ লোকজনের মধ্যে পোস্ট অফিসের আগ্রহও অনেকটা হ্রাস পেয়েছে।

 

চট্টগ্রামের লোকজন যুগযুগ ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, জাপান, আফ্রিকা মহাদেশ ও ইউরোপের দেশগুলোতে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। এক সময় পরিবার-পরিজনের খোঁজ-খবর নেওয়ার তাদের একমাত্র উপায় ছিল চিঠিপত্র আদান-প্রদান। আর এর প্রধান মাধ্যম ছিল ডাকঘর। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাত্র দুই যুগের ব্যবধানে পাল্টে গেছে চট্টগ্রামের প্রতিটি ডাকঘরের চিত্র। পত্র প্রাপ্তির স্বার্থে ডাকপিয়নের আগে যে কদর ছিল তা এখন আর নেই। ডাকপিয়নকে খুঁজতে এখন কেউ আর ব্যস্ত হয়ে ওঠে না। বাড়িতে থাকা মহিলারা ডাকপিয়নের পথ চেয়ে থাকে না। পুত্রের পাঠানো চিঠি কিংবা মানি-অর্ডারের অপেক্ষার প্রহর গুনেন না মা। কারণ এখন প্রয়োজন হলেই মুহূর্তেই যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে গেছে মোবাইল ফোন। দ্রæত টাকা পেতে ব্যাংক চ্যানেল কিংবা বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠানের দ্রæত সার্ভিসের কারণে আগের মতো বিদেশ থেকে ব্যাংক ড্রাফট পাঠায় না প্রবাসীরা। অফিস-আদালতের জরুরি তথ্য মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইলে আদান-প্রদান হচ্ছে বেশি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কিছু চিঠিপত্র আদান-প্রদান হলেও ডাক বিভাগের ধীরগতির কারণে তা দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলো। শহরের কয়েকজন পোস্ট মাস্টার জানান, বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও বীমার কিছু চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয়ে থাকে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে।

 

চট্টগ্রাম বিভাগের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল শরীফ মো. সাইফুল্লাহ পূর্বকোণকে বলেন, ‘মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্টারনেট ও ই-মেইলের ব্যবহারের আগে চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার বিদেশি চিঠি, ২০ থেকে ২৫ হাজার লোকাল চিঠি এবং পাঁচ শতের মতো ব্যাংক ড্রাফট আসতো। দেশের অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মানি অর্ডার হতো প্রচুর। কিন্তু এখন ব্যক্তিগতের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের চিঠি আসে বেশি। একইসাথে বেড়েছে পার্সেলও।’

 

শরীফ মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তির যুগে ডাক বিভাগের এ চিত্র শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশে^। ডাক বিভাগ এখন ই-কমার্সের দিকে ঝুঁকছে। এটির জনপ্রিয়তাও ক্রমে বাড়ছে।’

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট