
এই বছরের জুলাইয়ের শুরুতে চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। কদিন পরেই পবিত্র আশুরা উপলক্ষে সেই দাম এক লাফেই ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এরপর থেকে আর কমেনি মুরগির দাম। এখন বাড়তে বাড়তে দাম ঠেকেছে ১৭৫-১৮০ টাকায়। পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মুরগির বাচ্চার দাম বেড়েছে, তাই বাধ্য হয়ে তাদেরও দাম বাড়াতে হয়েছে।
পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের দাবির প্রমাণ মেলে মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে। কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই দেশের বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে মুরগির বাচ্চার দাম। প্রায় তিন মাস ধরে বেশি টাকা দিয়ে মুরগির বাচ্চা কিনতে হচ্ছে খামারিদের। সেটির প্রভাব পড়েছে ভোক্তা পর্যায়ে।
পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা জানান, কয়েক মাস আগেও ২৫ টাকায় মুরগির একদিনের বাচ্চা পাওয়া যেতো। পরে সেটি বাড়তে বাড়তে ৪০ টাকায় পৌঁছে। কিন্তু সম্প্রতি আরও বেড়েছে বাচ্চার দাম। এখন একটি মুরগির বাচ্চা কিনতে তাদের ৫০-৫৮ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি রিটন প্রসাদ চৌধুরী বলেন, মুরগির বাচ্চার দাম ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিনের একটা বাচ্চা কিনতে এখন দাম পড়ছে ৫৮ টাকা পর্যন্ত। খামারে রেখে সেগুলোকে খাবার খাইয়ে, ওষুধ ও ভ্যাক্সিন দিয়ে বড় করতে কয়েকগুণ খরচ পড়ে যায়। এরপর পাইকারি দরে মুরগিগুলো আমরা বাজারে বিক্রি করি। খরচ অনুযায়ীই দাম পাচ্ছি না, লাভের সুযোগ কোথায়?
সাধারণত একদিনের একটি বাচ্চা মুরগি এক কেজি পর্যন্ত ওজনের হতে সময় লাগে ২৫ থেকে ২৬ দিন। দুই কেজি ওজনের হতে সময় লাগে ৫ সপ্তাহের বেশি। বাজারে এই দুই ওজনের ব্রয়লার মুরগির চাহিদাই বেশি।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ পড়ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। প্রতিদিন দেশে গড়ে ৫ হাজার ২০০ টন মুরগি ও চার থেকে সাড়ে চার কোটি ডিম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রান্তিক খামারিরা সরবরাহ করেন প্রায় তিন হাজার টন মুরগি ও তিন কোটি ডিম। এখন ক্রমেই খরচ বেড়ে চলায়, প্রতিদিনই কোনো না কোনো খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
গতকাল নগরীর বহদ্দারহাটে ব্রয়লার মুরগি ১৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ওই এলাকার মা পোল্ট্রি সাপ্লায়ার্স নামের একটি মুরগির দোকানের মালিক মোহাম্মদ হৃদয় দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমারা অন্যান্য এলাকার চেয়ে কম দামে মুরগি বিক্রি করি বলে সুনাম আছে। কেননা আমাদের নিজেদের খামার রয়েছে। কিন্তু এখন মুরগির বাচ্চার দাম বেড়ে গেছে। উৎপাদন খরচ বাড়ায় আমাদেরও বেশি দামে মুরগি বিক্রি করতে হচ্ছে।’
একই কথা বলেন দুই নম্বর গেটের কর্ণফুলী কমপ্লেক্স বাজারের ইফাজ ইফরান পোল্ট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি বলেন, কিনতে হচ্ছে বেশি দামে, তাই দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই।
মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দেশের অন্যতম বৃহত্তম মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মসের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিক্রয় কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হায়দার দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, সম্প্রতি একদিনের মুরগির বাচ্চার দাম কিছুটা বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণেই এটি হয়েছে। বর্তমানে লোমেন জাতের বাচ্চা ৪৭ এবং ক্রস জাতের বাচ্চা ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত বছরের এই সময়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল মুরগির দাম। ওই সময়ে ২০০ টাকার ওপরে চলে যায় ব্রয়লার মুরগির দাম। এরপর সরকার বাজারে মুরগি ও ডিমের দাম বেঁধে দেয়। সরকারের হস্তক্ষেপের পর মুরগির বাচ্চার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে। চলতি বছরের শুরু থেকে মুরগির দাম ১৩০-১৪০ টাকার মধ্যে চলে আসে। জুন পর্যন্ত দাম সেই দামেই ছিল। কিন্তু জুলাই থেকেই বাড়তে শুরু করে দাম। এখন মুরগির বাচ্চার দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, সিন্ডিকেটের প্রভাব এবং ফিডের দাম বাড়ায় মুরগি লালনপালন করা খামারিরা যেমন চ্যালেঞ্জে পড়েছেন তেমনি বেশি দামে মুরগি কিনতে হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারাও।
গতকাল বহদ্দারহাটে মুরগি কিনতে এসে দাম শুনে আশ্চর্য হন গৃহবধূ সাহেদা আক্তার। তিনি বলেন, মাছ-মাংসের দাম এতই বেশি-খাওয়ার সাধ্য নেই। দাম কিছুটা কম থাকায় ছেলে-মেয়েদের মুরগিটা খাওয়াতাম। এখন মনে হচ্ছে, আমাদের পাত থেকে মুরগিও উঠে যাবে। ক্রমেই বেড়ে চলেছে এই মুরগির দাম। সরকারের নজরদারি না বাড়ালে মনে হয় না দাম কমবে।
পূর্বকোণ/ইবনুর