চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

‘প্রিয় সোহান লাশ হয়ে গেলো’
সোহান আল মাফির

‘প্রিয় সোহান লাশ হয়ে গেলো’

তাসনীম হাসান

৪ অক্টোবর, ২০২৫ | ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

দুই বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় ছোট্ট বেলার এক বন্ধুকে হারিয়ে পৃথিবীটাই ছোট হয়ে গিয়েছিল সোহান আল মাফির। সেই স্মৃতি ফেসবুকে তুলে ধরে এই তরুণ লিখেছিলেন, ‘আমার ছোট বেলার বন্ধু রাফি। আর কখনো মানুষের গল্প বলবে না। সকলে ওর জন্য দোয়া করবেন।’

 

কিন্তু কে জানতো বন্ধুর সেই দেখানো ‘পথেই’ সোহানও হারিয়ে যাবেন অপঘাতে! গোসল করতে নেমে মাতামুহুরীর বুকে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছেন এই তরুণ। ২৭ বছরের প্রাণোচ্ছল তরুণ আর কখনো বলবেন না গল্প, বলবেন না-‘চল বন্ধু কোথাও ঘুরতে যাই।’

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সোহান আল মাফি ছিলেন মেধা ও সংস্কৃতির মিশেলে উজ্জ্বল এক তরুণ। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি মঞ্চের সাবেক সভাপতিও। যার উচ্চারণ-আবৃত্তিতে অনেককেই ছুঁয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। অবসরে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার প্রাণের খোরাক। সেই ঘোরার নেশাতেই এক বন্ধুকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বান্দরবানের লামায়। সাদা পাহাড় এলাকায় মাতামুহুরী নদীতে গোসল করতে নেমে স্রোতের তোড়ে তলিয়ে যান সোহান। একদিন পর গতকাল শুক্রবার দুপুরে তার নিথর দেহ মেলে ৪০ হাত গভীরে, নদীর তলদেশে।

 

আবৃত্তি মঞ্চের প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাছুম আহমেদ বৃহস্পতিবার সোহান নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই উৎকন্ঠায় ছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন সুখবরের। কিন্তু এলো যে দুঃসংবাদ! সোহানের মরদেহ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই এই শিক্ষক ফেসবুকে লিখলেন হৃদয় বিদারক বাক্যটি, ‘প্রিয় সোহান লাশ হয়ে গেলো।’

 

সোহানকে ঘিরে ভালোলাগার স্মৃতি ফেসবুকে তুলে ধরেছেন তারই লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষক কায়সার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এই শিক্ষক লিখেছেন, ‘শিক্ষকদের কিছু প্রিয় শিক্ষার্থী থাকে। সোহান ছিল আমার এরকম একজন ছাত্র। সামনের বেঞ্চেই বসতো। নিয়মিত ক্লাস করতো ভদ্র ছেলেটা। সহশিক্ষা কার্যক্রমেও ছিল সমান পারদর্শী। ক্যাম্পাসে আবৃত্তি নিয়ে কাজ করতো। এমন একটা শিক্ষার্থীকে হারিয়ে ফেললাম চিরতরে।’

 

বন্ধুদের কাছে সোহান ছিলেন ভ্রমণ-অন্তপ্রাণ। ব্যস্ততার কাছ থেকে এক টুকরো ছুটি পেলেই বন্ধুদের একজোট করে তিনি নিয়ে যেতেন পাহাড়ে, নদীর ধারে কিংবা সমুদ্রতটে। কিন্তু বিশ^বিদ্যালয় জীবনশেষে চাকরি, ব্যস্ততা, দৌড়ঝাঁপ- জীবনের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া এই ‘অবাঞ্চিত অতিথিদের’ কারণে সেই ভ্রমণ আর তেমন একটা হতো না।

 

বন্ধুদের নিয়ে একত্র হওয়ার সময়গুলোর কথা ভেবে ফেসবুকে আক্ষেপের সুরে তাই সোহান লিখেছিলেন, ‘সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এখন দেখা করতে হলে এক মাস আগে সিদ্ধান্ত নিতে হয় কে কবে ফ্রি, কার অফিস অফ বা ক্লাস নেই কার। একত্রিত হলেও গল্প-আড্ডার টপিকে বদল এসেছে। এখন কথা হয় চাকরি, বিয়ে, পরিবার, স্মৃতিচারণ বা হঠাৎ জীবনের মায়া ত্যাগ করে ওপারে চলে যাওয়া বন্ধুটিকে নিয়ে। কিন্তু এই তো সেদিনও হঠাৎ ধুম করে ডিসিশন নিয়ে ঘুরতে চলে যেতাম। আগের মতো কফি হাউসেই বসা হয় আমাদের। তবে মান্না দের ‘কফি হাউসের’ মতোই সময়ের সঙ্গে সবার অবস্থারও পরিবর্তন দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।’

 

কফি হাউসের সেই বিখ্যাত গানে সাতবন্ধুর কথা বলা হলেও অবশ্য সোহানের দলে ছিল ছয়জন। এখন সেই দলও ভেঙে গেলো-একজন চলে গেলেন সবার আগেই। যেন গ্র্যান্ডের গিটারিস্ট গোয়ানিস ডিসুজার মতোই সময়ের আগেই হারিয়ে গেলেন সোহান-বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে, পৃথিবীর সব গল্প ফেলে, শুয়ে পড়লেন অনন্ত ঘুমে!

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট