
চট্টগ্রাম শহর আজ এক অদ্ভুত বৈপরিত্যের মুখে দাঁড়িয়ে। একদিকে নগর উন্নয়ন, সৌন্দর্যবর্ধন ও আধুনিকায়নের হাজারো পরিকল্পনার ঘোষণা। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়, ফ্লাইওভার, বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছপালা ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো অবৈধ ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনে ভরা। এই বৈপরিত্যের মূল কারণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
চসিকের সীমাবদ্ধতা ও গাফিলতি:
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী, কোন পোস্টার-ব্যানার বা ফেস্টুন টাঙাতে হলে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু নগরবাসী জানে, এই নিয়ম শুধু কাগজে-কলমেই আছে। বাস্তবে অনুমতিহীনভাবে শহরের প্রতিটি মোড় দখল হয়ে যায় রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে। চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগ মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা লোক দেখানো। কয়েকদিন পর আবার একই জায়গা পোস্টারে ঢেকে যায়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- কেন চসিক কঠোর অবস্থান নিচ্ছে না? এই উত্তর সবার জানা। এখানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা জড়িত। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বিকার ভ‚মিকা নেয়। নাগরিকদের আক্ষেপ, সিটি কর্পোরেশন যদি নাগরিক স্বার্থের বদলে প্রভাবশালীদের খুশি রাখতে ব্যস্ত থাকে, তবে নগরীর সৌন্দর্য রক্ষা করা অসম্ভব।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তা:
পোস্টার-ব্যানার শুধু সৌন্দর্যহানি ঘটায় না, এটি পরিবেশের ওপরও সরাসরি আঘাত হানে। গাছে পেরেক ঠুকে সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে, ফলে গাছগুলো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ছে। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। তাদের দায়িত্ব পরিবেশের ক্ষতি ঠেকানো; কিন্তু তারা এ বিষয়ে কার্যত নীরব। মাঝে মাঝে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি দিলেও মাঠপর্যায়ে আইনের কোন প্রয়োগ দেখা যায় না।
পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব এড়ানো:
সড়ক দখল কিংবা ঐতিহাসিক স্থাপনা আড়াল করা- এসব কার্যকলাপ সরাসরি জননিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে এগুলো থামাতে পারতো। কিন্তু রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে তারা এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয় না। পুলিশ শুধু জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রণেই ব্যস্ত। অথচ শহর দখল হয়ে যাওয়া তাদের চোখেই পড়ে না।
দায় এড়ানোর সংস্কৃতি:
প্রশাসনের মধ্যে দায় এড়ানোর প্রবণতা স্পষ্ট। চসিক বলে, ‘আমরা পরিষ্কার করি, কিন্তু মানুষ আবার লাগায়।’ পরিবেশ অধিদপ্তর বলে, ‘এটা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব।’ পুলিশ বলে, ‘এটা রাজনৈতিক বিষয়।’ এই দায়সারা মনোভাবের কারণে আজ চট্টগ্রাম ব্যানার-পোস্টারে ডুবে আছে।
জনগণের ক্ষোভ, প্রশাসনের উদাসীনতা:
নগরবাসী দীর্ঘদিন ধরেই এই ভোগান্তির কথা বলে আসছে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, নাগরিক সমাজ অভিযোগ তুলেছে; কিন্তু প্রশাসন এখনও কার্যকর কোন নীতি গ্রহণ করেনি; পদক্ষেপ তো নয়ই। রাজনৈতিক দলগুলোও নীরব। কারণ এ সংস্কৃতি থেকে তারা নিজেরাই লাভবান। জনগণের ক্ষোভকে উপেক্ষা করে তারা নিজেদের স্বার্থে শহরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
করণীয় কী?:
প্রথমত, সিটি কর্পোরেশনকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। অনুমতি ছাড়া কোন ব্যানার-পোস্টার লাগালে সঙ্গে সঙ্গে অপসারণ ও জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ অধিদপ্তরকে সক্রিয় হয়ে গাছ ও পরিবেশ সুরক্ষায় নামতে হবে। তৃতীয়ত, পুলিশ প্রশাসনকে জননিরাপত্তার অংশ হিসেবে এ বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা দেখাতে হবে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, ব্যানার-পোস্টারের সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে জনসমর্থন বাড়বে না, বরং জনগণের ঘৃণা বাড়বে। নগরবাসীর ইচ্ছাকে সম্মান জানানো এখন তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
চট্টগ্রামের সৌন্দর্য আজ প্রশাসনের গাফিলতি ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ক্ষতিগ্রস্ত। নিয়ম আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই; আইন আছে, কিন্তু সদিচ্ছা নেই। এভাবে চলতে থাকলে চট্টগ্রাম নগরী একটি বিশৃঙ্খল শহরে পরিণত হবে। সময় এসেছে প্রশাসনকে দায় স্বীকার করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। অন্যথায় ‘বিউটিফিকেশন’ শুধু মুখের কথা হয়েই থেকে যাবে। আর নগরবাসীর ভোগান্তি ক্রমেই বাড়বে।
পূর্বকোণ/ইবনুর