
চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র বা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চর্চার ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯২৯ সালে অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্তের ‘সুকুমারী’ সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলা সিনেমার যাত্রা শুরু হলেও ৭০-৮০ এর দশকে চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলোতো সগৌরবে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে ৯০ দশকের শেষ দিকে এসে আস্তে আস্তে সিনেমা হলগুলোতে দর্শক সংখ্যা কমতে থাকে। দর্শকের অভাবে একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে সিনেমা হল। সর্বশেষ বন্ধের লিস্টে যোগ হয় নগরীর ফিনলে স্কয়ারে অবস্থিত আধুনিক ব্যবস্থা নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রথম মাল্টিপ্লেক্স ‘সিলভার স্ক্রিন’। যা ২০১৮ সালের যাত্রা শুরু করেছিল।
সিলভার স্ক্রিনের পর চট্টগ্রামে দ্বিতীয় মাল্টিপ্লেক্স হিসেবে চালু হয় স্টার সিনেপ্লেক্সের একটি শাখা। নগরীর বালি আর্কেড শপিং মলে তিন স্ক্রিনের মাল্টিপ্লেক্সটি এখনো সচল রয়েছে।
বন্ধের কারণ হিসেবে জানা যায়- গেলো বছর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সময় থেকেই হলের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। ক্রমাগত লোকসানের কারণে ছবি চালানো বন্ধ করা হয়।
তার উপর ভারতীয় ছবি আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় দর্শকের আনাগোনা অনেক কমে যায়। যার কারণে লোকসানের হারও বাড়ে। এমনকি ঈদ ছাড়া উল্লেখযোগ্য ভালো ছবি না আসায় বছরজুড়ে লোকসান গুনতে হয়। যার কারণে প্রথম মাল্টিপ্লেক্সটি বন্ধ হয়ে যায়।
এক সময় নব্বই দশকের দিকে টিভিতে সপ্তাহে একটি চলচ্চিত্র প্রচার হতো। কিন্তু নব্বই দশকের শেষ দিকে অনেকগুলো টিভি চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করে। এসব টিভি চ্যানেল চালু হওয়ার পর প্রতিদিনই চলচ্চিত্র প্রচার হতে থাকে। মূলত এসময় থেকে সিনেমা হলে দর্শকপ্রিয়তা কমতে থাকে। আবার পাইরেসি বিষয়টাও দর্শককে হলে যেতে বাধা দিয়েছে। নতুন একটা সিনেমা মুক্তি পেলো- মুক্তির পরদিনই সেটা অনলাইনে পাওয়া যায়। তাহলে মানুষ কেনো হলে গিয়ে ছবি দেখবে। তার উপর স্মার্ট ফোনের ব্যবহার, ওটিটিতো রয়েছেই।
প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয়। সমস্ত পৃথিবীর উপর নজরদারি করার জন্য এক স্মার্ট ফোনই যথেষ্ট। আর বিনোদনের দুনিয়াও কিন্তু পিছিয়ে নেই। নাটক-সিনেমা দেখার জন্য টিভি বা সিনেমা হলে যাওয়ার ঝক্কি ঝামেলাও কমিয়ে দিয়েছে এই স্মার্ট ফোন। দেশ-বিদেশের নাটক, কিংবা ওয়েব সিরিজ সবই পাবেন এখন ঘরে বসেই।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা: এক সময় সারা বাংলাদেশে ১২০০টির মতো সিনেমা হল ছিল। সেখানে বর্তমানে ২০০টিরও কম সিনেমা হল আছে। সিনেমা হলের দুর্দশার কারণে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষ বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেশিরভাগ সিনেমা হল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন ও মার্কেট। টিভি চ্যানেল, মোবাইল, ইন্টারনেটের কারণে সিনেমা ব্যবসা ধ্বংস হয়ে গেছে। ছবি রিলিজ হওয়ার আগে পাইরেসির মাধ্যমে তা মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। দশ টাকা দিয়ে মোবাইলে ছবি দেখা যাচ্ছে। ফলে কেন বেশি টাকা খরচ করে সিনেমা হলে ছবি দেখতে আসবে। পাইরেসি রোধ করা যাচ্ছে না।
বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সিনেমা হল কমে যাওয়ার ফলাফল কি জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সভাপতি শৈবাল চৌধুরী বলেন, এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় অনেক কথা বলেছি। নিম্ন-মধ্যবিত্তের লোকজনের অন্যতম বিনোদন মাধ্যম হলো সিনেমা হল। সিনেমা হল কমে গেলে তারা যাবে কোথায়? এর ফলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে যাবে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের লোকজন খারাপ পথে চলে যাবে। গাঁজা খাবে, মারামারি করবে, খারাপ জায়গায় যাবে।
আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে করণীয়: এ ব্যাপারে সভাপতি শৈবাল চৌধুরী বলেন, ‘ভালো হল না থাকলে ভালো সিনেমা হবে না। আবার ভালো সিনেমা না হলে হল ভালো হবে না। একটি সিনেমা হলে ১০০০-১৫০০ আসনের দরকার নেই। প্রত্যেক জেলা শহরে একটি করে সিনেপ্লেক্স তৈরি করতে হবে। একটি সিনেপ্লেক্সের ভিতর চারটি হল থাকবে। ঢাকা শহরে চারটি সিনেপ্লেক্স ও একুশটি সিনেমা হল আছে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আশাজাগানিয়া ব্যাপার: ওটিটির চরম দাপটে চলচ্চিত্র শিল্পের যে ধস, তাতে বলা যায় এ শিল্প কোমায় চলে গেছে। তারপরও কিছু কিছু সিনেমা আবার আশা জাগায়। ২০২৫ সালের সিনেমা ‘বরবাদ’। যা সারা বিশ্বে ৭৫ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। এটিই চলচ্চিত্র শিল্পে সবচেয়ে বেশি আয় করা বাংলা সিনেমা। আয়ে-র দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছে- ২০২৪ সালের সিনেমা ‘তুফান’। যা সারা বিশ্বে ৫৬ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তৃতীয় তালিকায় রয়েছে ২০২৩ সালের সিনেমা ‘প্রিয়তমা’। এটিও ৪২ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তারপর ২০২৫ সালের ছবি ‘তাণ্ডব’, ৩০ কোটির ব্যবসা করেছে। ৬ নম্বরে রয়েছে ২০২৪ সালের ছবি ‘রাজকুমার’, যা ২৬ কোটি টাকা ব্যবসা করে। এ তালিকা বড্ড আশা জাগায়। যদি ভালো মানের মৌলিক গল্প, পাইরেসি, ভালো হল, সুন্দর ব্যবস্থা থাকে তাহলে আবার হলমুখী হবে মানুষ।
পূর্বকোণ/ইবনুর