চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামে বিনোদনে বাণিজ্যিক আগ্রাসন
নগরীর প্রায় সিনেমা হল বন্ধ হলেও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কে সি দে রোডের সিনেমা প্যালেস

২৯টি সিনেমা হলের মধ্যে চালু মাত্র দুটি

চট্টগ্রামে বিনোদনে বাণিজ্যিক আগ্রাসন

অনুপম চৌধুরী

২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

২০০৪ সাল। সবে ভর্তি হই সরকারি সিটি কলেজে। তখন বিনোদন বলতে ছিল টেলিভিশন। শুক্র-শনিবার ছিল সিনেমা দেখার দিন। বাড়ির সাদাকালো টেলিভিশন চলত ব্যাটারি দিয়ে। শুক্রবার ছিল পাড়া-প্রতিবেশীদের মিলনমেলা। সবাই সিনেমা শুরুর আগেই হাতের কাজ শেষ করে বসে যেতো টিভির সামনে। নির্দিষ্ট টাইমে ছাড়া হতো টিভি। অন্যথায় চার্জ চলে যাবে-সেই ভয়ও কাজ করত। গ্রামে তখন ডিস সংযোগ না থাকায় ওই দুদিনই ছিল বিনোদনের প্রধান ভরসা। সেসব ছেড়ে শহরে এসে পেয়ে গেলাম বিনোদনের বিশাল রাজ্য। নগরীর প্রায় কম-বেশি সিনেমা হলে আমি সিনেমা দেখেছি। আমার প্রথম সিনেমা দেখা ‘লায়ন সিনেমা হল’-এ। তখন টিকেটের দাম সম্ভবত ১৩ বা ১৭ টাকা ছিল। সিনেমা দেখার ফাঁকে বিরতি কিংবা একদম শেষে পরের সপ্তাহের সিনেমার ট্রেলার দেখানো হতো। আসিতেছে… অমুকের পরিচালিত সিনেমা…। এই ট্রেলার দেখার পর পুরো সপ্তাহ মুখিয়ে থাকতাম পরের সপ্তাহের সিনেমাটা দেখার জন্য।

 

সিনেমার সুদিন : সত্তর, আশি, নব্বই দশকে সিনেমা হলগুলোর রমরমা অবস্থা ছিল। সে সময়ের বিষয়টা না দেখলেও দেখেছি ২০০৮ সালে পরিচালক এস এ হক অলিকের ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’। ছবিটি দারুণ ব্যবসা করেছিল। ২০০৬ সালে ‘হৃদয়ের কথা’ ছবির সাফল্যের পর ছবিটি নির্মাণ করেন এবং এটি তার পরিচালনায় দ্বিতীয় ছবি। নায়ক রাজ রাজ্জাক, রিয়াজ ও পূর্ণিমা অভিনীত এই ছবিটি আশানুরূপ সাফল্য পেয়েছিল। এই সিনেমার সুবাদে কণ্ঠশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ, এস আই টুটুল ও নাজমুন মুনিরা ন্যান্সির গাওয়া গানগুলো তখন তরুণ দর্শক শ্রোতাদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। তারপরের বছরই গিয়াস উদ্দিন সেলিমের রচনা ও পরিচালনা মুক্তি পায় ‘মনপুরা’। এই ছবিটি পরিচালনার মধ্য দিয়ে সেলিম প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। গ্রামবাংলার পটভূমিতে নির্মিত, পারিবারিক ও প্রেমের গল্পের এই ছবিটিতে প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করছেন চঞ্চল চৌধুরী ও ফারহানা মিলি। এটি ২০০৯ সালের সেরা ব্যবসা সফল ছবি ছিল। এই প্রত্যেকটি সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছিলাম। টিকিট না পাওয়ায় ব্লু যাকে নিয়েছিলাম।

 

সময়টাও বেশি দিনের না। তখনও সিনেমার সুদিন ছিলো। ভালো গল্প, ভালো মেকিং থাকলে দর্শক সিনেমা দেখেছে। তাহলে বর্তমান অবস্থা কি? বর্তমানে মানুষ কি সিনেমা দেখে না? আর যদি সিনেমা না-ই দেখে তাহলে কেনইবা সিনেমা দেখছে না?

 

এই যে একটা সিনেমার মুক্তি। সিনেমা দেখার টানটান উত্তেজনা এখন কি আর আছে? মোটেও নেই। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব বিষয় স্বপ্ন দেখার মতো। তারা কল্পনাও করতে পারবে না, তখন প্রায় সবকটি সিনেমা হল হাউসফুল থাকত।

 

চট্টগ্রাম শহরের প্রেক্ষাগৃহ : চট্টগ্রামে একমসয় ৩৯টি সিনেমা হল ছিল। এর মধ্যে নগরীতে ২৯টি, নগরীর বাইরে ছিল আরও ১০টি সিনেমা হল। এখন অবশিষ্ট আছে শুধুমাত্র ২টি।

 

নগরীর সিনেমা হলগুলো : লায়ন (সদরঘাট), রুঙ্গম (কোতোয়ালি), সিনেমা প্যালেস কেসিদে রোড), খুরশীদ মহল (লালদিঘী), উজালা (স্টেশন রোড), আলমাস (চট্টেশ্বরী), দিনার (চট্টেশ্বরী), জলসা (নিউমার্কেট), গুলজার (চকবাজার), নূপূর (স্টেশন রোড), মেলোডি (স্টেশন রোড), বনানী (আগ্রাবাদ), সানাই (বারিক বিল্ডিং), উপহার (আগ্রাবাদ), রিদম (আগ্রাবাদ), অলংকার (পাহাড়তলী), আকাশ (অলংকার), ঝুমুর (কাজির দেউড়ি), কর্ণফুলী (মোহরা), পূরবী (পাথরঘাটা), গুলশান (ঝাউতলা), রেলওয়ে নেভি হল (টাইগার পাস), গ্যারিসন (সেনানিবাস) পতেঙ্গা (নেভি হল), শাহীন (পতেঙ্গা বিমান বাহিনী), বিডিআর হল (হালিশহর), সাগরিকা (নেভি ফ্লিটক্লাব), ক্যান্টনমেন্ট (নতুন পাড়া), চাঁদনী (অক্সিজেন), সংগীত (্আতুরার ডিপো)।

 

শহরের বাইরে হলগুলো : গ্যারিসন (বিএমএ, ভাটিয়ারি), পরাগ (বাড়বকুণ্ড), রূপালি (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), ঝংকার (নাজিরহাট), বনশ্রী (পেপার মিল, রাঙ্গুনিয়া), বনলতা (রাঙ্গুনিয়া), বিডিআর (বাইতুল ইজ্জত, সাতকানিয়া), সবুজ (পটিয়া) ও ছন্দা (পটিয়া)।

 

কমলবাবু থিয়েটার থেকে লায়ন : চট্টগ্রামের প্রথম সিনেমা হল লায়ন এর অবস্থান ছিল সদরঘাটে হোটেল শাহজাহানের বিপরীতে। লায়ন প্রথমে কোন সিনেমা হল ছিল না। এটা চট্টগ্রামের এক জমিদার পরিবারের অধীনে কমলবাবু থিয়েটার নামে একটা অডিটোরিয়াম ছিল। ওই অডিটোরিয়ামে বাইরের বিশেষ কেউ এলে অনুষ্ঠান হতো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও এই কমলবাবুর থিয়েটারে সংবর্ধনা দেয়া হয়। উদয় শংকরও ওই থিয়েটারে নাচের অনুষ্ঠান করে গেছেন। কমলবাবুর থিয়েটার পরে হাত বদল হয়ে আরেক জমিদারের কাছে যায়। তিনি তার বাবার নামে এটির নামকরণ করেন ‘বিশ্বম্ভর থিয়েটার’।

 

১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ঢাকার চলচ্চিত্র প্রদর্শক আব্দুল কাদের সদ্দারের কাছে এই হল বিক্রি করে দেন। ওই সময় তাদের ঢাকায় আরেকটি সিনেমা হল ছিল। যার নাম ছিল লায়ন। ঢাকা সদরঘাটের ইসলামপুর এলাকায় এই হলটি এখনও চালু আছে। কিন্তু আগের পরিসর থেকে কিছুটা ছোট করে, নাম পরিবর্তন করে ‘লায়ন সিনেমাস’ নামে চলছে। সেই লায়নের নামেই বিশ্বম্ভর থিয়েটার হয়ে যায় ‘লায়ন সিনেমা হল’। এই লায়ন সিনেমা হল হয় ১৯২৬ সালে। লায়ন সিনেমা হল হওয়ার পর এটি অডিটোরিয়াম থেকে পূর্ণাঙ্গ সিনেমা হলে রূপ নেয়। এটি ১০-১২ বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে একে একে প্রায় সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র ২টি হল। কেনো বন্ধ হলো তা জানতে পড়তে হবে আগামী পর্ব।

 

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন : চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সভাপতি শৈবাল চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে একসময় ৩৯টি সিনেমা হল ছিল। এরমধ্যে নগরীতে ২৯টি ও নগরীর বাইরে ছিল আরও ১০টি সিনেমা হল। এখন অবশিষ্ট আছে শুধু ২টি। নগরীর কাজির দেউড়ি এলাকার ঝুমুর (যা পরবর্তীতে নাম পাল্টে হয় সুগন্ধা) এবং কেসিদে রোডের সিনেমা প্যালেস এখনও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।’

 

লায়ন সিনেমা হল নিয়ে সদরঘাট এলাকার শুভ হেয়ার ড্রেসারের মালিক পিন্টু আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘মনে হচ্ছে এইতো সেদিন সিনেমা দেখার জন্য কতো কতো লাইন। টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে অনেকে। অনেকে তার পরের শো’র জন্য অপেক্ষা করছে।’

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট