
বাতাসের গায়ে শরতের গন্ধ। নীল আকাশে তাই মেঘতুলোর ওড়াউড়ি-কখনো সাদা, কখনো কালচে রূপ ধারণ করা ধূসর। রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা তাই লেগে আছে দিনভর। আকাশের মতো ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানোর এই দৃশ্য যেন প্রতীকী হয়ে ধরা দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে। প্রার্থীরা কখনো ভোটারকে কাছে পেয়ে হাসিমুখে হাত মেলাচ্ছেন, আবার কখনো ভোটের অঙ্ক কষতে কষতে মুছছেন কপালে জমে থাকা ঘামবিন্দু!
সবুজে ঘেরা পাহাড়ের বুক চিরে দাঁড়িয়ে শ্বেতশুভ্র তিনতলার চাকসু ভবনটি। বাইরে থেকে নিরীহ সাদা, ভেতরে যেন উত্থালপাথাল উত্তেজনা। ভবনটির ভেতরে-বাইরে গতকাল বৃহস্পতিবার পড়ন্ত বিকেলে দুই ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে দেখা গেল সবখানে প্রার্থীদের আনাগোনা। কেউ মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন, কেউবা ব্যস্ত প্যানেল ঘোষণার প্রস্তুতিতে। প্রায় ৩৫ বছর পর এই ভোটযুদ্ধ ফিরে আসছে, তাই আগ্রহও তুঙ্গে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার পারদ এতটাই বেশি, ‘সাদা ভবনে’ যাওয়ার এই লড়াইয়ে প্রতি ২৩ ভোটারের মধ্যে প্রার্থী হয়েছেন একজন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদ মিলিয়ে ২৭ হাজার ৬৩৪ জন ভোটারের বিপরীতে প্রার্থী সংখ্যা ১১৬২।
ক্যাম্পাসের কলা অনুষদের ঝুঁপড়ির আড্ডায় তাই কেউ কেউ রসিকতা করছিলেন, ‘যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই প্রার্থী!’ অবশ্য গতকাল মনোনয়নপত্র জমাদান শেষে সেই প্রার্থীর তালিকা আরও কমতে পারে।
ছাত্রদলের প্যানেলে ‘চমক’ আসতে পারে-আগেই বাতাসে ওড়াউড়ি করেছিল। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নিজেই উপস্থিত হয়ে প্যানেল ঘোষণা করবেন-এমন খবরে দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ আরও বাড়ে। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে ছাত্রদল প্যানেল ঘোষণার সময় তাই বিশ^বিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরের আশপাশে ভিড় লেগে যায়। ছাত্রদল প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছে বিতর্কহীন ও জুলাই বিপ্লবে সক্রিয় থাকা ছাত্রনেতাদের রাখতে।
২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে ব্যাপক মারধরের শিকার হয়েছিলেন ছাত্রদলের তখনকার দপ্তর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়। পরে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য ও পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। জুলাই বিপ্লবেও ছাত্রদলের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক হৃদয় মাঠে ছিলেন। ভিপি হওয়ার লড়াইয়ে হৃদয়কেই বেছে নিয়েছে ছাত্রদল। জিএস পদে মনোনয়ন পেয়েছেন যশোরের কেশবপুরের ছেলে মো. শাফায়াত হোসেন। চবিতে ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ পদে এর আগে চট্টগ্রামের বাইরের কাউকে তেমন একটা ভাবা হতো না, সেই জায়গায় শাফায়াতের নামটা বেশ চমকই!
ছাত্রশিবিরের প্যানেলের মূল পদগুলোতে কারা থাকবেন-সেটি ঘোষণার আগেই ‘ফাঁস’ হয়েছে। জারুলতলায় প্যানেল ঘোষণার সময় সেটির ব্যতিক্রম হলো না। ছাত্রশিবিরও তাদের প্যানেলে শাখা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে রাখেনি। ভিপি পদে জুলাই বিপ্লবে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা ইব্রাহিম হোসেন রনিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। স্ত্রী-সন্তান-সংগঠন সামলে ভালো ফল করায় ৫ আগস্টের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় এসেছিলেন সাঈদ বিন হাবিব। ‘জনপ্রিয়’ সেই মুখকেই জিএস পদে প্রার্থী করেছে ছাত্রশিবির।
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়াদের নিয়ে সৃষ্টি হওয়া ছাত্র সংগঠন-বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস) ‘মতবিরোধের’ কারণে চাকসু নির্বাচনে প্রার্থী দিচ্ছে না আগেই জানা গিয়েছিল, তবে সংগঠনটির একটি অংশ স্বতন্ত্র প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তাদের পাশাপাশি বাম ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়ে গড়া জোট নিয়েও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি স্বতন্ত্র প্যানেল ভোটের মাঠে নেমেছে। তবে প্রার্থী বাড়লেও অবশ্য মূল আলোচনায় আছে বড় ছাত্রসংগঠনগুলো। ফলে লড়াইটা দুই ভাগে-একদিকে দলীয় ছায়াতলে থাকা শক্তিশালী প্রার্থীরা, অন্যদিকে স্বতন্ত্ররা। শিক্ষার্থীরা এখন ভাবছেন, তারা কাকে বিশ্বাস করবেন-দলীয় পরিচয়ের ভরসাকে, নাকি স্বতন্ত্র মুখের অঙ্গীকারকে।
শহীদ মিনার এলাকায় পাওয়া গেল প্রথম বর্ষের একদল শিক্ষার্থীকে। তাঁরা বলছিলেন, ক্যাম্পাসে আসার পর থেকেই আবাসন নিয়ে কষ্টে আছেন। শাটলে পর্যাপ্ত বগি না থাকায় যাতায়াতের ভোগান্তিও নিত্যসঙ্গী। হলের মানহীন খাবারে পেট ভরে না। এসব সমস্যার সমাধানে যারা কাজ করতে পারবেন বলে মনে হবে-তাদেরকেই তারা জয়ী করে কেন্দ্র ও হল সংসদে পাঠাবেন।
তবে আশার উল্টোপিঠে শঙ্কাও আছে। ইসরাত জাহান দেশের রাজনীতিকদের ‘চরিত্র’ তুলে ধরে বলছিলেন, ভোটের আগে সবাই আসে, কিন্তু ভোটের পর আর কাউকে পাওয়া যায় না। চাকসুতে যেন সেটি না হয়। নির্বাচিতরা রাজনীতি না করে আমাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো সমাধান করবেন এটাই চাওয়া। প্রার্থীরাও ভোটারদের মন জয় করতে পারে এমন ইশতেহার-ভিশনের কথা তুলে ধরে আসছেন নিয়মিত।
চাকসুর সাদা ভবনটি তাই এখন কেবল আর একটি স্থাপনা নয়, সেটি পরিণত হয়েছে এক স্বপ্নের প্রতীকে। সবার মুখেই একই কথা-এখানে যারা নেতৃত্বে বসবেন, তারা যদি সত্যিই শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে পারেন, তবে সাদা ভবনের রঙ অম্লান থাকবে। আর যদি সেই আস্থা ভেস্তে যায়, তবে সাদা দেয়ালগুলোও ম্লান হয়ে যাবে সময়ের ধুলোয়।
পূর্বকোণ/ইবনুর