
‘এখানকার ব্যবসায়ীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে বাংলাদেশি ক্রেতা। তাদের ওপর নির্ভর করে দোকানপাট, হোটেল-লজ গড়ে উঠেছে। এক বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য তেমন নেই।’ কথাগুলো বললেন ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যের ভেলোর শহরের মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী মো. আকবর। একই কথা বললেন আরও অনেক ব্যবসায়ী-হোটেল মালিক। তাদের ভাষ্যমতে, ভিসা জটিলতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ৮০ শতাংশ কমেছে।
ভেলোর থেকে প্রায় ১৭শ কিলোমিটার দূরে কলকাতা শহরের বড় বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, বাংলাদেশি ক্রেতা কমে যাওয়ায় বড় প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে।
বড় বাজারের দোকানি শ্রী জয়ন্তী স্টোরের মালিক শ্যাম বললেন, এক সময়ে পুরো ভারতে এ বাজার থেকে নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক সব ধরনের পণ্য সরবরাহ করা হতো। ভিসা জটিলতার কারণে বাংলাদেশি ক্রেতা কমে যাওয়ায় এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, এই বাজার হচ্ছে পশ্চিম বঙ্গের সবচেয়ে বড় ও প্রধান বাজার। বাংলাদেশি ক্রেতা না থাকায় এখানেও ৩০-৪০ শতাংশ প্রভাব পড়েছে।
ভারতের ভেলোর ও কলকাতায় মাসখানেক অবস্থানকালে অন্তত অর্ধ শতাধিক ব্যবসায়ী, হোটেল মালিক-কর্মচারী ও নানা শ্রেণি লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। ভেলোর শহরের ব্যবসায়ীদের ভাষ্য মতে, ১২৫ বছর ধরে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে খ্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ (সিএমসি) হাসপাতাল। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি হাজার হাজার রোগী চিকিৎসাসেবা নেন। এই চিকিৎসাকেন্দ্রকে ঘিরে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে হোটেল-লজ, মানি এক্সচেঞ্জ, ট্রাভেল এজেন্সি, পরিবহন ব্যবসা, বিপণি-বিতানসহ নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বাংলাদেশি সংকটে ধুঁকছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
ভেলোরের এম এ ট্যুর এন্ড ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মো. একরাম বলেন, আগের তুলনায় বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য সিকি পরিমাণে নেমে এসেছে। বাংলাদেশি যাত্রী সংকটে চেন্নাই-ঢাকা রুটে বিমান চলাচল কমে গেছে। সপ্তাহে দু-তিনটি বিমান চলাচল করে। অথচ আগে যাত্রীর চাপে দিনে এক কোম্পানির একাধিক বিমান চলাচল করতো। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে ভিসা জটিলতায় বাংলাদেশি রোগী কমে যায়। আশা করছি, বাংলাদেশে নির্বাচন ও নতুন সরকার আসলে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য আগের ধারায় ফিরবে।
ভেলোর বাবু রয় স্ট্রিটের ওষুধের দোকানি রাজা বলেন, ‘ভিসা জটিলতায় বাংলাদেশি লোকজন আসতে না পারায় ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব বিরাজ করছে। ব্যবসা চার ভাগের এক ভাগও নেই বললে চলে।’
ভেলোর সিএমসি হাসপাতাল ছাড়াও শ্রী নারায়ণী ও নারুবী এবং চেন্নাই এপোলোসহ কয়েকটি বিখ্যাত হাসপাতাল রয়েছে। এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতি মাসে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। এরমধ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি পর্যটক আসেন চিকিৎসাসেবা নিতে। ভারতের চেন্নাই, ভেলোর ছাড়াও কলকাতা, আসাম, ঝাড়খন্ডসহ বিভিন্ন রাজ্যের লোকজনও চিকিৎসাসেবা নেন সিএমসিসহ এসব হাসপাতালে। ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে তামিললাড়ুর লোকজন বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছেন। বর্তমানে সব ধরনের ব্যবসায় চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে।
জুয়েলারি দোকানি মীর আহমদ বলেন, ‘পোশাক-পরিচ্ছেদ ও জুয়েলারি পণ্যের প্রধান ক্রেতা হচ্ছে বাংলাদেশি। প্রতিটি পণ্য এখন লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, চিকিৎসাসেবা নিতে আসা ভারতীয় লোকজন ভেলোর থেকে কেনাকাটা করেন না। কারণ ভারতীয় পণ্য তাদের নিজ জেলা-শহরে হাতের নাগালে স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করেন।
প্রবীণ হোটেল ব্যবসায়ী আকবর বশর বলেন, বাংলাদেশি লোকজনের সংখ্যা ৮০-৮৫ শতাংশ কমে গেছে। আয়ও চার ভাগের তিন ভাগ কমে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এমন মন্দাভাব আর হয়নি।
কলকাতার হালচাল :
এক বছর ধরে ভিসা জটিলতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ‘মিনি বাংলাদেশ’ খ্যাত কলকাতার ব্যবসায়ীরা। গত এক বছরে কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যে হাজার কোটি রুপির বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকা ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি পর্যটকদের প্রিয়। এক বছর আগেও এই এলাকায় পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকত। এক বছর ধরে এসব এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক কমে গেছে।
কলকাতা-বাংলাদেশ বাস পরিবহন সার্ভিসের অনিল দাশ বলেন, আগে বিভিন্ন কোম্পানির বাস নিয়মিত চলাচল করতো। এখন সব কোম্পানি মিলে মারকুইস থেকে বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত দিনে একটি বাস চালায়।
কলকাতার হুমায়ুন কবীর নামে এক হোটেল কর্মচারী বলেন, বাংলাদেশি কমে যাওয়ায় ছোট ছোট অনেক হোটেল-লজ বন্ধ হয়ে গেছে।
গত কয়েক দিন আগে কলকাতার বড় বাজার ও নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুর্গোৎসব উপলক্ষে বেচাকেনা এখন জমজমাট। একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, পূজা ছাড়াও ঈদে বড় বেচাকেনা হয়। এক বছর ধরে বেচাকেনা তেমন নেই।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী খান জানান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ভ্রমণ এজেন্সি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, চিকিৎসা ও পরিবহন-সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি রুপির ব্যবসা হতো। নিউ মার্কেট ও বুররাবাজারের ক্ষতি হিসাবে ধরলে বার্ষিক ক্ষতির অঙ্ক ৫ হাজার কোটি ছাড়াবে।
পরিসংখ্যান বলছে, চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর ৫ লাখ বাংলাদেশি দেশের বাইরে যায়। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণত প্রতি বছর ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন প্রায় ২০ লাখ বিদেশি রোগী। যার ৬০ শতাংশই বাংলাদেশি। গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমে গেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে সরকারের পতন ঘটে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়নে ভিসা জটিলতা দেখা দেয়।
পূর্বকোণ/ইবনুর