চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

ঝুঁকিতে হাতির ১২ করিডোর
রাঙ্গুনিয়ায় সংরক্ষিত বনে হাতির দল। ছবি: আইইউসিএন।

ঝুঁকিতে হাতির ১২ করিডোর

নাজিম মুহাম্মদ

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

হাতির দল নিয়মিত চলাচলের জন্য যে পথ ব্যবহার করে তাকে করিডোর বলা হয়। বর্ষার শুরুতে যখন খাবার ও পানি সহজলভ্য থাকে, হাতি তখন বনাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রীষ্মকালে খাবার ও জলের উৎস কমে যায়, তখন হাতি সেই সব আবাসস্থলে চলে যায় যেখানে খাবার ও আশ্রয় পাওয়া যায়। যখন মানুষের কারণে হাতির চলাচলের পথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন সেই অঞ্চলে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

 

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, পূর্বে অনুন্নত এলাকায় নতুন বসতি স্থাপন, চাষাবাদের ভূমির ব্যবহারে পরিবর্তন, অবকাঠামো এবং বনজ সম্পদের উপর মানুষের নির্ভরতার কারণে হাতির করিডোরের দিন দিন অবনতি ঘটে। এতে হাতি এক বন থেকে অন্য বনে খাদ্য, জল, আশ্রয় এবং প্রজননের জন্য খন্ডিত ও অবনতিশীল আবাসস্থল ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। হাতির জনসংখ্যা টিকে থাকার জন্য করিডোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

এশীয় হাতি বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি, যা বাংলাদেশে ‘মহাবিপন্ন’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ বনবিভাগের নয়টি বনে হাতির বর্তমান জনসংখ্যার অবস্থা নির্ণয়, চলাচলের পথ ও করিডোর চিহ্নিতকরণে যৌথভাবে জরিপ চালিয়েছে আইইউসিএন (আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়ন) ও বাংলাদেশ বন বিভাগ। ২০১৩ সালের আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছর জরিপ চালানো হয়। জরিপে ৪৪টি বন রেঞ্জে হাতিদের বিচরণ রেকর্ড করা হয়, যার মধ্যে নয়টি বন বিভাগের অধীনে থাকা সংরক্ষিত ও রক্ষিত বন অন্তর্ভুক্ত। দেশে হাতি চলাচলের মোট এলাকা ১,৫১৮ বর্গ কি.মি.। জরিপে বাংলাদেশে ২৬৮টি স্থায়ী বন্য হাতি, ৯৩টি পরিযায়ী হাতি এবং ৯৬টি পালিত হাতির তথ্য মিলেছে। ১২টি করিডোর ও ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত হাতি পারাপারের স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি করিডোর কক্সবাজার উত্তর, তিনটি কক্সবাজার দক্ষিণ এবং চারটি চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে। হাতি বছরের পর বছর একই পথ অনুসরণ করে। তাই হাতি টিকে থাকতে করিডোর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

হাতির ১২ করিডোর: উখিয়া-ঘুমধুম: করিডোরটি লামা বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নাইক্ষংছড়ি এবং উখিয়ার হাতির আবাসস্থলকে যুক্ত করেছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের কারণে দুটি আবাসস্থল বিভক্ত হয়ে পড়েছে। করিডোরটি নাইক্ষ্যংছড়ি, কুতুপালং, ঘুমধুম, তুমব্রু, আঝুহাইয়া, মধুরছড়া, বটতলীগোনা, বালুখালী, পালংখালী থেকে সোয়াংখালী পর্যন্ত বিস্তৃত।

 

তুলাবাগান-পানেরছড়া: করিডোরটি কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের তুলাবাগান এবং পানেরছড়ার হাতির আবাসস্থলের সাথে যুক্ত হয়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের কারণে দুটি আবাসস্থল বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই করিডোরের উভয় পাশে সামাজিক বনায়ন রয়েছে। উত্তর দিকের গাছ কাটার কারণে এই আবাসস্থলটি এখন বৃক্ষশূন্য।

 

নাইক্ষংছড়ি-রাজারকুল: এই করিডোরটি রাজারকুল রেঞ্জের মধ্যে অবস্থিত যা লামা বনবিভাগের নাইক্ষ্যংছড়ির হাতির আবাসস্থল এবং কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তুলাবাগানের সাথে যুক্ত হয়েছে। রামু-মরিচ্যা সড়ক এই দুটি আবাসস্থলকে বিভক্ত করেছে।

 

ভোমারিয়াঘোনা-রাজঘাট: করিডোরটি ঈদগাঁও রেঞ্জ এবং ফুলছড়ি রেঞ্জের হাতির আবাসস্থলকে যুক্ত করেছে। ঈদগাঁও-বাইশারী সড়ক এই করিডোরের মধ্য দিয়ে গেছে। করিডোরের তুলাতলী, পানেরছড়া, ভোমারিয়া, রাজঘাট থেকে খুটাখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হাতি চলাচল করে।

 

তুলাতলী-ঈদগড়: কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের সংরক্ষিত বনের তুলাতলী বিট এবং ঈদগড় বিটের হাতির আবাসস্থলকে যুক্ত করেছে এ করিডোর। আরাকান সড়ক এই করিডোরের মধ্য দিয়ে গেছে। এটি ঈদগড়, লামা থেকে তুলাতলী, মাছুয়াখালী ও কলিরছড়া পর্যন্ত বিস্ত্তৃত।

 

খুটাখালী-মেধাকচ্ছপিয়া: মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্ক ফুলছড়ি রেঞ্জের একটি বিট, এটি এমন একটি ভূখণ্ড যেখানে শেষ গর্জন বনভূমি রয়েছে, যা অতীতের বনজ সম্পদের ধারক। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক করিডোরটিকে বিভক্ত করেছে।

 

ফাঁসিয়াখালী-ছৈরাখালী: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক বিভক্ত করেছে এ করিডোর। ফসল কাটার মৌসুমে (মার্চ-এপ্রিল- সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর মাসে) হাতি এ করিডোর নিয়মিত ব্যবহার করে। করিডোরটির অবস্থান সংরক্ষিত বনে।

 

ফাঁসিয়াখালী-মানিকপুর: লামা-কক্সবাজার সড়ক এই করিডোরের মধ্য দিয়ে গেছে। করিডোরের উভয় পাশে ঝোপঝাড়, গাছপালা, আগর বাগান রয়েছে। এটি ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, পূর্বে কুমারী, লামা এবং উত্তরে মানিকপুর, কাকারা ও নলবিলা সংরক্ষিত বনে অবস্থিত।

 

চুনতি-সাতগড়: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এই করিডোরের মধ্য দিয়ে গেছে। কক্সবাজার দক্ষিণ, লামা, চট্টগ্রাম দক্ষিণ এবং বান্দরবান বনবিভাগের হাতি ব্যাপকভাবে এই করিডোর ব্যবহার করে। করিডোরের একপাশে একাশিয়া ও পাইন গাছের বাগান (সাতগড় বিট) এবং অন্য পাশে প্রাকৃতিক বন চুনতি অভয়ারণ্য (চুনতি বিট) রয়েছে।

 

লালুটিয়া-বরদুয়ারা: এ করিডোর দোহাজারী (লালুটিয়া বিট) এবং পদুয়া সংরক্ষিত বনের (বরদুয়ারা বিট) হাতির আবাসস্থলকে সংযুক্ত করেছে। এটি লালুটিয়া, দোহাজারী, দুধপুকুরিয়া, ধোপাছড়ি অভয়ারণ্যকেও সংযুক্ত করেছে।

 

সুখবিলাস-কোদালা: সুখবিলাস এবং কোদালা বনের হাতির আবাসস্থল সংযুক্ত করেছে এ করিডোর। যেখানে ঋতুভিত্তিক হাতি চলাচল করে। শ্রীমাই, কমলাছড়ি, খুরুশিয়া, সুখবিলাস থেকে শিলক, কোদালা ও কাপ্তাই পর্যন্ত বিস্তৃত।

 

নারিশ্যা-কোদালা: এ করিডোরটি নারিশ্যা এবং কোদালার বনভূমিকে সংযুক্ত করেছে। রাজারহাট থেকে গোডাউন পর্যন্ত সড়ক করিডোরের পাশ দিয়ে চলে গেছে।

 

সুপারিশ: হাতি চলাচলের জন্য ১২ করিডোর রক্ষায় আইইউসিএন যে সব সুপারিশ করেছে তা হলো, করিডোর ঘোষণা ও সীমানা নির্ধারণ এবং আইনি সুরক্ষা প্রদান, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ কমানো। বন-নির্ভরশীল মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, বাগানকে প্রাকৃতিক বনে রূপান্তর করা। করিডোর এলাকা প্রশস্ত করা, কুমির প্রজনন কেন্দ্র, রাবার বাগান অফিস, টেলিভিশন কেন্দ্র এবং শরণার্থী শিবির স্থানান্তর। পাহাড় কাটা, মাটি উত্তোলন, পোল্ট্রি ফার্ম স্থানান্তর করা।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট