
ঢাকার উত্তরা থেকে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারের যাচ্ছিলেন গোলাম সরোয়ার। বহুদিন পর ‘পর্যটনের রাজধানীতে’ ভ্রমণ; স্বাভাবিকভাবেই সবার মুখেই ছিল হাসির ঝিলিক, মন ভরে ছিল আনন্দে। কিন্তু কে জানতো-সেই খুশি দ্রুতই মিলিয়ে যাবে শোকের অন্ধকারে।
মিরসরাইয়ের ঠাকুরদিঘী এলাকায় তাদের বহনকারী প্রাইভেটকারটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কাভার্ডভ্যানের পেছনে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সরোয়ার ও তাঁর মেয়ে মুসকান। পরে মারা যান শ্যালক মো. সাগরও। প্রাণে বাঁচলেও গুরুতর আহত হয়েছেন স্ত্রী-পুত্র।
বাংলাদেশের সড়ক যেন প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে একেকটি পরিবার। আগে যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা মানেই ছিল এক-দুজনের প্রাণহানি সেখানে এখন একসঙ্গে পুরো পরিবার কিংবা পরিবারের একাধিক সদস্যের মর্মান্তিক অকালপ্রয়াণ যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যার সর্বশেষ সংযোজন, গতকাল শুক্রবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একই পরিবারের দুজনের মৃত্যুর ঘটনাটি।
ভয়াবহ পরিসংখ্যান: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশের সড়কে ৩৪ হাজার ৮৯৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৭ হাজার ৩৮২ জন। প্রতিবছর ১ হাজারের ওপর মানুষ চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম নগরীতে তিন বছরে ৩৬২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত হওয়া এসব মানুষের মধ্যে অনেক পরিবারের একাধিক সদস্য রয়েছেন। অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিং, চালকের ক্লান্তি ও প্রশিক্ষণের অভাব, মানহীন যানবাহন, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, সড়কের ত্রæটিসহ নানা কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে গবেষণায় উঠে আসছে।
একটি দুর্ঘটনা, শেষ পুরো পরিবার: গত ২৪ আগস্ট কক্সবাজারের রামুতে প্রাইভেটকারের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষে মারা যান ঢাকার যাত্রাবাড়ীর এক পরিবারের বাবা, ছেলে, মা, বোনসহ চারজন। এর আগে ২৫ জুলাই লোহাগাড়ায় মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ও ট্রাকের ত্রিমুখী সংঘর্ষে একই পরিবারের দুই ভাই ও তাদের মামা নিহত হন। ১ এপ্রিল কুষ্টিয়া থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে সেই লোহাগাড়া এলাকাতেই সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৫ জন নিহত হন। ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চকরিয়ারর মলুমাঘাটে পিকআপ চাপায় একসঙ্গে ছয় ভাই-বোনের মৃত্যু দেশজুড়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলো দেশবাসীকে। বাবার শ্রাদ্ধকর্ম সেরে ভোরে বাড়িতে ফেরার সময় দুর্ঘটনায় পড়েন তাঁরা।
গতকাল আচমকা স্বামী-কন্যাকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন গোলাম সরোয়ারের স্ত্রী উম্মে সালমা। এই নারী বলেন, ‘দুর্ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে আমার পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেলো। আমার বহুকষ্টে গড়া সাজানো সংসারটি তছনছ করে দিল।’
বিশিষ্টজনেরা বলছেন, একই পরিবারের একাধিক সদস্য একসঙ্গে মারা যাওয়া কেবল একটি পরিবারের নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্য বড় ক্ষতি। হঠাৎ করেই এতিম হয়ে যাওয়া শিশু, বিধবা স্ত্রী বা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের বেদনা মাপার ভাষা নেই। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই ক্ষতি মারাত্মক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ড. রুমানা আক্তার দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘একই সময়ে যদি একটি পরিবারের অনেকই চলে যান, তখন যারা বেঁচে থাকেন তাদের কাছে এটি হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রমা। এই ট্রমার মাত্রা এতটাই বেশি থাকে, যার কারণে অনেক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন মানুষ। এর মধ্যে অন্যতম হলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)। এটি এমনই আতঙ্কের, একটা মানুষকে ঠিকমতো ঘুমাতে দেবে না। ঘুমের মধ্যে বারবার ওই দুর্ঘটনার স্মৃতি স্বপ্নে ধরা দেবে আর আতঙ্কে জেগে তুলবে। অর্থাৎ ওই স্মৃতি বারবার ফ্ল্যাশব্যাক হবে।’
এই দুঃসহ স্মৃতি থেকে ভুক্তভোগীকে বেরিয়ে আনতে কিছু সুপারিশ দিয়েছেন ড. রুমানা আক্তার। তিনি বলেন, ‘একটা মানুষ মা-বাবা বা স্ত্রী-সন্তান কিংবা ভাই-বোন হারিয়ে ফেললে জীবনের মানেই হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থা থেকে স্বাভাবিকজীবনে ফিরতে হলে তাকে অনেকগুলো বিষণ্ণতা পার হয়ে আসতে হবে। তার পিটিএসডি ডেভলপ করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্র, পরিবার, কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করতে হবে। সব সহযোগিতা একত্রিত হলেই ট্রমা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।’
সরকার উদ্যোগী হলে এসব ট্রাজেডি শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সোচ্চার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুর বছরে সড়ক দুর্ঘটনার হার এক শতাংশে নামিয়ে এনেছে। রাস্তা ঠিক থাকলে, চালকের লাইসেন্স থাকলে, সিগন্যাল ঠিক থাকলে এবং সবাই নির্দেশনা মেনে চললে তারা দুর্ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলছে। তার অর্থ, মানুষ চাইলেই এগুলো দূর করতে পারে।’
অতীতে পরিবারের একাধিক সদস্যকে হারানো কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় দৈনিক পূর্বকোণের। তাঁদের সবার বক্তব্য একই-‘একটি দুর্ঘটনা, আমাদের দিয়ে গেছে এক জীবনের কান্না।’
পূর্বকোণ/ইবনুর