চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

৬৯ শতাংশ কোচিং সেন্টার অবৈধ
ফাইল ছবি

বিশেষ প্রতিবেদন

৬৯ শতাংশ কোচিং সেন্টার অবৈধ

মিজানুর রহমান ও ইমরান বিন ছবুর

১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

নগরের ‘শিক্ষাপাড়া’ খ্যাত চকবাজারের প্রাণকেন্দ্র গুলজার মোড়। মোড়ের পাশেই বহুতল ভবন গুলজার টাওয়ারে বিসিএস, মেডিকেল ভর্তিসহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক কোচিং পরিচালনা করছে ১৬ প্রতিষ্ঠান। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে-এই ১৬ কোচিং সেন্টারের মধ্যে ৭টির কার্যক্রম চলছে অবৈধভাবে। কোনো নিবন্ধন ছাড়াই।

 

শুধু গুলজার টাওয়ারে নয়-চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে কোচিং সেন্টারের কার্যক্রম চলছে প্রায় সব এলাকায়। এর ফলে একদিকে যেমন সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকির বাইরে থাকছে কোচিং সেন্টারগুলো। প্রশ্ন উঠছে তাদের কার্যক্রম নিয়েও।

 

চসিকের তথ্য অনুযায়ী-নগরের ৬টি রাজস্ব সার্কেল এলাকায় ২৩৪টি কোচিং সেন্টার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে এরমধ্যে ৬৯ শতাংশ বা ১৬২টি কোচিং সেন্টারের কোনো নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স নেই। বাকি ৭২টির নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স থাকলেও ৪৯টি কোচিং সেন্টার সেটি নবায়ন করেনি। অর্থাৎ নিয়ম মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে মাত্র ২৩টি কোচিং সেন্টার।

 

স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯ এর ১১১ ধারা অনুযায়ী-সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নিবন্ধন ব্যতীত বেসরকারিভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে টিউটোরিয়াল স্কুল বা কোচিং সেন্টার চালু করা যায় না। নিবন্ধনের জন্য কর্পোরেশন কর্তৃক নির্দিষ্টকৃত ফি জমা দিয়ে মেয়র বরাবর আবেদন করতে হয়। মেয়র বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় তদন্ত করে সন্তুষ্ট হলে সংশ্লিষ্ট টিউটোরিয়াল স্কুল বা কোচিং সেন্টারকে নিবন্ধন করেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে মাসিক ফি ধার্য করে দেন। এই আইন অনুযায়ী চট্টগ্রাম নগরে কোচিং সেন্টার চালুর আগে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চসিকের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এস এম সরওয়ার কামাল। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া কোনো কোচিং সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনা করা অবৈধ। ট্রেড লাইসেন্স না থাকলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং জরিমানার পর যতদিন ট্রেড লাইসেন্স করবে না, ততদিন পর্যন্ত দৈনিক ৫০০ টাকা করে জরিমানার বিধান রয়েছে।

 

অবৈধ কোচিং সেন্টার বেশি পাহাড়তলীতে:

 

চসিকের তথ্য অনুযায়ী-রাজস্ব সার্কেল-৬ এর অধীন পাহাড়তলী ও হালিশহর এলাকায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ কোচিং সেন্টার রয়েছে। এসব এলাকায় কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ৪৬টি। এরমধ্যে ৪৫টির ট্রেড লাইসেন্স নেই। বন্দর, পতেঙ্গা ও ইপিজেড এলাকা নিয়ে গঠিত রাজস্ব সার্কেল-৮ এ অবৈধ কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ৪২টি। এই সার্কেলে থাকা বাকি ৩টি কোচিং সেন্টারের লাইসেন্স থাকলেও সেগুলো নবায়ন করা হয়নি।

 

রাজস্ব সার্কেল-৭ এর আওতাধীন আগ্রাবাদ এলাকায় কোচিং সেন্টার রয়েছে ৩৮টি। এরমধ্যে ৩২টির কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেই। বাকি ৬টির মধ্যে ২টির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। ট্রেড লাইসেন্স আছে ৪টির। শিক্ষাপাড়া চকবাজার রাজস্ব সার্কেল-২ এর অধীন। এই এলাকায় কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ৭৫টি। এরমধ্যে লাইসেন্স নেই ২৯টির। লাইসেন্স নবায়ন করেনি ৩২টি। ট্রেড লাইসেন্স আছে ১৪ প্রতিষ্ঠানের।

 

ষোলশহর, শুলকবহর, পাঁচলাইশ এলাকা নিয়ে গঠিত রাজস্ব সার্কেল-১ এ অবৈধ কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ৭টি। লাইসেন্স আছে ৪টির। তবে এরমধ্যে ৩ প্রতিষ্ঠান সেটি নবায়ন করেনি। এছাড়া রাজস্ব সার্কেল-৫ এর অধীন জামালখান, লালখান বাজার ও জিইসি এলাকায় মোট কোচিং সেন্টার রয়েছে ১৯। এরমধ্যে মাত্র ৩টির ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন আছে। বাকি ১৬টি কোচিং সেন্টারের মধ্যে ৭টিরই ট্রেড লাইসেন্স নেই।

 

বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার:

 

কোচিং সেন্টার চালু করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। বছর বছর ফি দিয়ে সেটি নবায়ন করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডসহ নানা খাতের জন্য আলাদা ফি রয়েছে। নিয়ম মেনে প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রেড লাইসেন্স না নেওয়ায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে চসিক। শুধু চসিকের রাজস্ব নয়, ভ্যাটও ফাঁকি দিচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলো। টাকার অঙ্কে যা কোটি টাকার বেশি।

 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন-সিটি কর্পোরেশনের তালিকায় ২৩৪টি কোচিং সেন্টারের তথ্য উঠে এলেও বাস্তবে এই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। যেখানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী মাসিক ফি বা কোর্স ফি দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেন। চলে জমজমাট কোচিং বাণিজ্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) তদারকি কার্যক্রম বাড়ালে এই খাত থেকেই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা সম্ভব।

 

প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন:

 

কেবল অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না কোচিং সেন্টারগুলো; চসিকের অনুমতি ছাড়া প্রচারণামূলক ব্যানার-পোস্টারও লাগাচ্ছে তারা। চসিকের কর্মকর্তারা জানান- নগরে ব্যানার-পোস্টার লাগানোর আগে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে কোচিং সেন্টারগুলো সেই নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। যেখানে-সেখানে ইচ্ছেমতো ব্যানার-পোস্টার লাগিয়ে নগরের সৌন্দর্যহানি ঘটাচ্ছে তারা।

 

চসিকের রাজস্ব বিভাগের তথ্যানুযায়ী-৮০ শতাংশ কোচিং সেন্টার তাদের ব্যানার-পোস্টার লাগানোর আগে চসিকের অনুমতি নেন না। একটি ব্যানার বা সাইনবোর্ডের জন্য মাত্র এক-দুই হাজার টাকা কর প্রদান যথেষ্ট হলেও তারা সেটি পরিশোধ করেন না। উল্টো তাদের ছড়ানো লিফলেট, হ্যান্ডবিলের কারণে নগরে ময়লা-আবর্জনা বাড়ছে। পোস্টারের দেয়ালগুলো নষ্ট হচ্ছে। ব্যানারের কারণে নগরের সৌন্দর্যহানি ঘটছে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট