চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

সাগর ও নদী দূষণে হারাচ্ছে ইলিশ
নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী রানী রাসমনি ঘাটে নৌকা থেকে ইলিশের ঝুড়ি নিয়ে আসতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা

সাগর ও নদী দূষণে হারাচ্ছে ইলিশ

মিটু বিভাস

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১২:৩৩ অপরাহ্ণ

ইলিশ মৌসুম মানে উপকূলে আনন্দের দিন। পুরো বছর ঝিমিয়ে পড়া জেলে পাড়াগুলো যেন হঠাৎ জেগে ওঠে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ক্রেতা বিক্রেতাদের হাক-ডাকে সরগরম থাকে। কিন্তু তিনবছর ধরে সেই উৎসব যেন ভাটা পড়েছে। কাক্সিক্ষত ইলিশের দেখা নেই সমুদ্রে। জেলেদের জালে যেসব ইলিশ ধরা পড়ছে তা আকারে অত্যন্ত ছোট। আর তাই নৌকা ভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতে পারছে না কেউ। অন্যদিকে ক্রেতারাও খালি হাতে ফিরছেন।

 

মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে পরিবেশ দূষণের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সাগরের পানি। নদীর নাব্যতা হারানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন। ফলে কাক্সিক্ষত ইলিশের দেখা মিলছে না সাগরে।

 

গতকাল দুপুরে নগরের দক্ষিণ কাট্টলী রানী রাসমনি ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, উপকূলে ইলিশের অপেক্ষায় হাজারও মানুষ। নৌকা থেকে ইলিশের ঝুড়ি নিয়ে উপরে উঠলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা। কিন্তু বেশিরভাগ মাছই জাটকা এবং দাম অনেক বেশি। ফলে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন ক্রেতারা। তবে ইলিশ নাম বলেই হয়তো বিক্রি থেমে নেই। পাইকারদের হাত ধরে বেশি দামে এসব মাছ চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

 

দক্ষিণ কাট্টলী এলাকার জেলে সর্দার খেলন জলদাস বলেন, এখান থেকে পাঁচ’শর বেশি নৌকা যায় সাগরে। এরমধ্যে সাড়ে তিনশ নৌকা স্থানীয় জেলেদের, যারা খুঁটি জালে মাছ ধরেন। যেগুলো সাগরে নির্দিষ্ট এলাকায় বসানো হয়। বাকি নৌকাগুলো ভাসা জাল দিয়ে গভীর সাগরে মাছ ধরতে যায়।

 

তিনি বলেন, খুঁটি জালে গত তিনবছর ধরে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যাচ্ছে তার বেশিরভাগ আকারে ছোট। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ জেলেরা। দাদন নিয়ে ইলিশ শিকার করতে গিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন তারা।

 

সলিমপুর এলাকার জেলে মিন্টু জলদাস বলেন, ইলিশ মৌসুমের আগে জাল ও নৌকা মেরামতের যে খরচ হয় তার অর্ধেকও তুলতে পারেনি এখানকার জেলেরা। আগামী মাসে আবারও আসছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এরপর ইলিশ আর পাওয়া যায় না। এর আগে খরচের টাকা তুলতে না পারলে পথে বসতে হবে অনেক জেলেদের।

 

সাগরে ইলিশ কম পাওয়া এবং আকার ছোট হওয়ার জন্য সাগর ও নদীর দূষণকে দায়ী করছে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। অব্যাহত দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। বিশেষ করে দেশি-বিদেশি প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব সাগর। শিল্প ও মানববর্জ্য তো আছেই, এর বাইরে নদীপথে ঢুকছে ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য। আর সমুদ্রগামী জাহাজের তেল দূষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন নদ-নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য হজম করছে সাগর। দেশের বিভিন্ন নদী দিয়ে এসব বর্জ্য আসছে সাগরে। যার কারণে বড় হতে পারছে না মাছ।

 

ইলিশ সাধারণত সাগরে থাকলেও ডিম ছাড়ার সময় চাঁদপুরের মেঘনা নদীর মোহনা দিয়ে পদ্মার মিঠা পানিতে চলে যায়। কিন্তু দূষণের কারণে প্লাস্টিক ও বর্জ্য জমে গিয়ে পদ্মা ও মেঘনার মোহনায় বিভিন্ন ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ডিম ছাড়ার সময় নদীতে প্রবেশে বাধা পাচ্ছে ইলিশ। তারপরও যেসব মাছ নদীতে যায় দূষণের কারণে বাধাগ্রস্ত হয় প্রজনন।

 

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, ইলিশের এ অবস্থার জন্য দূষণের দায় সবচেয়ে বেশি। স্বচ্ছ পানি ছাড়া ডিম ছাড়ে না ইলিশ। যার ফলে ইলিশ সাগর থেকে নদীতে গেলেও ডিম ছাড়ার জন্য স্বচ্ছ পানি খুঁজতে থাকে। কিন্তু দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত পদ্মা নদীও। আর তাই পদ্মায় গিয়ে স্বচ্ছ পানি খুঁজতে গিয়ে নদীর আরও গভীরে চলে যেতে থাকে ইলিশ। স্বাভাবিকভাবে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ছাড়তে পারে না এবং সঠিক প্রজননের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ইলিশ কমে যাওয়া এবং আকার ছোট হয়ে যাওয়ার এটাও অন্যতম কারণ।

 

এছাড়া প্রজননের জন্য নিষেধাজ্ঞার সময় নিয়ে রয়েছে দ্বিমত। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের মতে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ে। যে হিসেবে ৪ অক্টোবর থেকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা হওয়ার কথা। তবে অভিজ্ঞ জেলেসহ অন্যদের মতে আশ্বিন মাসের অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পরবর্তী একসপ্তাহ ইলিশ প্রজননের সময়। সে হিসেবে ১৭ অক্টোবর থেকে আসতে পারে ২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞা।

 

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞার সময় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণ করবে। প্রজননের সময় যদি সঠিকভাবে নির্ধারিত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতেও ইলিশ উৎপাদন ব্যাহত হবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট