চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

দুঃসময় দিয়ে গেলো ভালোবাসার পাঠ

তাসনীম হাসান

১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১২:২২ পূর্বাহ্ণ

কারও মাথায় কোপের দাগ, কারও শরীর রক্তে ভিজে লাল। আতঙ্ক আর কান্নায় ভেসে যাচ্ছে সবুজ ক্যাম্পাসের চারপাশ। সঙ্গীরা হাসপাতালে ছুঁটছেন আহতদের নিয়ে, কেউ রিকশার পেছনে ঝুঁকে, কেউবা আবার অ্যাম্বুলেন্সে-বাসে চেপে। রক্ত ঝরছে অবিরাম, তাই কারও প্রয়োজন পড়ে রক্তের ফোটা। দিনভর সংঘর্ষ আর আহতদের নিয়ে ছোঁটাছুটির কারণে অনেকের পেটে পড়েনি কোনো দানাপানিও।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসের অন্যতম রক্তাত্ত এই ‘দুর্দিনে’ বসে থাকেননি ছাত্রীরা। ছাত্রদের অনেকে রক্তে দিতে ছুঁটেছেন এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে। কেউ কেউ হলে হলে ব্যবস্থা করেছেন ভাড়া বাসায় থাকতে না পারা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা। এই দুঃসময়ে সবাই যেন ভরসা দিয়েছেন এই বলে, ‘ভয় নেই, আমি তোমার কাছেই আছি। আমি তোমাকে রক্ত দেব, ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাত দেব, তোমার হাতে ধরিয়ে দেব জীবনদায়ী ওষুধ। তুমি সেরে ওঠো ভাই…।’

ছাত্ররা যখন গ্রামবাসীদের সঙ্গে লড়ছেন, আহতদের নিয়ে ছুঁটছেন তখন ছাত্রীরা নিজেদের কাঁপা হাতে রান্না করেছেন হলের রান্নাঘরে। কেননা সংঘর্ষের কারণে ক্যাম্পাসের প্রায় সব খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। এতে কটেজে আর হলের বাইরে থাকা অনেক শিক্ষার্থীই খাদ্য সংকটে পড়েন। এমন দুঃসময়ে ছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে কেনেন চাল-ডাল-ডিম। পরে হলে সেসব খাবার রান্না করেন তাঁরা। এরপর দুপুরে আর রাতে সেসব খাবার শহীদ মিনারে বিতরণ করা হয়।

এই উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন তাহসিনা রহমান নামের এক ছাত্রী। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘হলে অবস্থান করা ছাত্রীরা উদ্যোগ নিয়ে চাঁদা তুলে খাবার সংগ্রহ করে রান্না করেছেন। আমরা বিতরণের দায়িত্ব নিয়েছি। প্রায় সাড়ে তিনশ জনের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছি। কটেজ ও শহরে থাকা যেসব ভাই আর আপুরা হলে থাকবেন তাঁদের জন্য এই খাবার। তারা আমাদের খাবার খেয়েছেন, কেউবা নিয়ে গিয়েছেন। এমন দুঃসময়ে একে অপরের পাশে থাকতে না পারলে কখন থাকবো।’

বিজয় চব্বিশ ও প্রীতিলতা হলের ছাত্রীরাও বসে থাকেননি। তাঁরাও শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার, পানি ও স্যালাইনের ব্যবস্থা করেন। এই ছাত্রীদের একজন রহিমা আক্তার বলেন, ‘আমরা দুই হলের ছাত্রীরা নিজেদের টাকা সংগ্রহ করে প্রায় ১০০ জনের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি পানি ও স্যালাইনও দিয়েছি। আমাদের এই সামান্য উদ্যোগে আহত ভাইদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করুক, এটাই আমাদের প্রার্থনা।’

আহত শিক্ষার্থীদের জন্য শুকনা খাবারসহ নানা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন ফয়জুন্নেসা হলের আরও কিছু ছাত্রী। পরে সেসব খাবার তাঁরা শহীদ মিনার এলাকায় বিতরণ করেন।

সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ক্যাম্পাসের দুই নম্বর গেট এলাকায়। সেখানে অনেক শিক্ষার্থী ভাড়া বাসায় থাকেন। তবে ওই এলাকাটি ক্যাম্পাসের বাইরে পড়ায় সেটি এখন অনিরাপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। সেজন্য সেখানে থাকা শিক্ষার্থীরা রাতে অবস্থান করা নিয়ে ঝামেলায় পড়েন। এমন দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন হলে অবস্থান করা ছাত্র-ছাত্রীরা।

প্রীতিলতা হলে নিজেদের কক্ষে ৬জন ছাত্রীকে রাখার ব্যবস্থা করেছেন ১৩২ নম্বর কক্ষের ছাত্রীরা। ওই ছাত্রীদের একজন উম্মে হানি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তাঁর কক্ষে যাওয়ার জন্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা ছাত্রীদের অনুরোধ জানিয়েছেন। একইভাবে ছাত্রদের জন্যও হলে থাকার ব্যবস্থা করেছেন অনেক ছাত্র। তাদের এই একজন আরাফাত অভি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে যারা কটেজে নিরাপত্তা বোধ করছেন না তাদের অতীশ দীপঙ্কর হলে যাওয়ার অনুরোধ জানান।

আহতদের নিয়ে এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ছুঁটেছেন অনেক ছাত্র। গুরুতর আহতদের রক্তের ব্যবস্থা থেকে হাসপাতালে ভর্তির সমন্বয় করা সবাই করেছেন তাঁরা। তাঁদেরই একজন ইসলামিক স্টাটিজ বিভাগের মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ক্যাম্পাস থেকে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকের অবস্থা খুবই গুরুতর ছিল। আমি রক্ত দিতে হাসপাতালে ছুঁটে গিয়েছিলাম। তবে কারও রক্তের প্রয়োজন পড়েনি। পরে আমিসহ অনেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পার্কভিউ এবং ন্যাশনাল হাসপাতালে আসা আহতদের ভর্তির ক্ষেত্রে সমন্বয় করি। তাদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের কাজ দেখে আনন্দে বুক ভাসিয়েছেন সবাই। কেউ শ্রদ্ধায় অবনত করেছেন মাথা। একটা সংঘাত যেন মানুষকে ভালোবাসার পাঠ দিয়ে গেল। আর রক্তের দাগের ভেতর রেখে গেলো আশ^াসের বাণী-আমরা আছি একে অপরের পাশে

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট