
‘আপা, এটা কাট্টলীর লইট্টা। রঙ ছাড়া, ছোট হলেও সেইরকম স্বাদ। তাই কমানো যাইব না। একদাম ১৮০ টাকা। ভালো লাগলে আমার থেকে নিয়েন আপা।’-কথাগুলো এক মহিলাকে বলছিলেন মাছ বিক্রেতা। লইট্টা থেকে শুরু করে ইলিশ, পোপা, সুরমা চিংড়ি, শিং, রূপচাঁদা, কোরাল, বাটা, তেলাপিয়া, পাবদা, রুই, মৃগেল কি নেই। সব ফ্রেশ ও টাটকা। আবার পাওয়া যায় তাজা শাক-সবজিও। গরুর দুধ, ডিম, যে কোন মৌসুমি ফল সব মিলছে এই অস্থায়ী বাজারে। বাজার অস্থায়ী হলেও নিত্যদিনের পারিবারিক সবকিছুই পাওয়া যায়।
বলছিলাম নগরীর জামালখানের সিঁড়ির গোড়ার অস্থায়ী বাজারের কথা। প্রতিদিন ভোর থেকেই শুরু হয় এই অস্থায়ী বাজারের কার্যক্রম। দিন বাড়ার সাথে সাথে ক্রেতা-বিক্রেতায় সরগরম থাকে এই সিঁড়ির গোড়ার এলাকা। যা চলে সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। দীর্ঘ কয়েক যুগের এই বাজারের চাহিদাও রয়েছে। শুধু জামালখানবাসী না, নানা জায়গা থেকে আগত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকও এই অস্থায়ী বাজারের কাস্টমার। নামে অস্থায়ী হলেও কাজে কিন্তু পুরো একটা কাঁচাবাজার। যা জামালখানবাসীর জন্য এক ভরসার জায়গা।
নগরীর বাসিন্দাদের প্রায়দিন কিছু না কিছু সবজি-মাছের বাজার করা লাগে। সে হিসেবে জামালখানের বাসিন্দারা এই অস্থায়ী বাজারকে স্বস্তির বাজার বলে মনে করেন। বাসা থেকে নামলেই হাতের কাছে পেয়ে যান প্রতিদিনের বাজার। আবার এই বাজারে কিছু মানুষ যে বিরক্ত নন, তাও কিন্তু নয়। বেশিরভাগ জামালখানবাসী এই অস্থায়ী বাজার থেকে বাজার করলেও অনেকে কাজীর দেউড়ি বা রেয়াজউদ্দিন বাজার থেকেও বাজার করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরকারি ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি এই বাজারে প্রায় ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে নানা কিছু বিক্রি করছি। আর্থিক অনটনে থাকায় স্থায়ী দোকান নিতে পারিনি। তাই এই অস্থায়ী বাজারেই আমার ভরসা। এখানে নানা জায়গা থেকে অনেক লোক বাজার করতে আসেন। যাদের হাতে অনেক পয়সা, তারা আবার গাড়ি করে কাজীর দেউড়ি বাজারে চলে যান।’
আগে বিক্রেতাদের কিছু মানুষকে চাঁদা দিতে হলেও এখন কাউকে চাঁদা দিতে হয় না বলেও জানান তিনি।
বেশিরভাগ স্কুল জামালখান এলাকায় হওয়ায় সকালবেলা স্কুলে যাওয়া অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বেশ বেগ পোহাতে হয়। তার উপর সিঁড়ির গোড়ার এই অস্থায়ী বাজার অনেকসময় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মেয়েকে স্কুলে দিতে আসা রাকিবুল চৌধুরী বলেন, ‘এ অস্থায়ী বাজারের কারণে সকালে বাচ্চাদের স্কুলে নিতে সমস্যায় পড়তে হয়। সকাল-সকাল অনেক ভিড় থাকে। হাঁটার রাস্তায় বাজার আর মূল রাস্তা চলে যায় ভ্যানগাড়ির দখলে। তার উপর বাজারে আসা কিছু লোকের প্রাইভেট গাড়ি রাস্তায় জ্যাম সৃষ্টি করে।’ বাজারের জায়গায় বাজার থাকাকে উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিদিন এই বাজার থেকে টুকটাক বাজার করেন ব্যাংকার নীল কমল। তিনি বলেন, ‘বাসার পাশে বাজার হওয়ায় বাজার করার যে একটা ঝামেলা তা পোহাতে হয় না। এই বাজার আমাদের অনেক উপকার করে। ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় জিনিস এখানে পাওয়া যায়। সব জিনিস টাটকা থাকে। মাছ কিনি অথবা মুরগী কিনি, সব কেটেকুটে সুন্দর করে নিতে পারি।’
শুধু যে জামালখানের লোকেরা এই বাজারের ক্রেতা তা কিন্তু নয়। অনেক ছেলে-মেয়েদের স্কুলে দিতে এসে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেন এই বাজার থেকে। তেমনি কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষক মাসুম খান প্রায়ই সকালে আসেন এই অস্থায়ী বাজারে। তিনি বলেন, ‘ডিসি হিলে শরীরচর্চা শেষে এখান থেকে মাছ কিনি। পুকুরের মাছ স্বাদে আলাদা। এই মাছ কাটার জন্যও আছেন বেশ ক’জন। এছাড়া তাজা শাক-সবজিও পাওয়া যায়। বড় কাঁচাবাজারের চাইতে এখানে দামও তুলনামূলক কম। কিন্তু কেনাকাটার সময়টাও খুব কম।’
এই অস্থায়ী বাজারে এক পাশে নিজ ফার্মের দুধ বিক্রি করেন লোকমান। দীর্ঘ দশ বছরেরও অধিক সময় ধরে তিনি দুধ বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘নিজস্ব ফার্মের দুধ বিক্রি করি। প্রয়োজনে মাঝে-মধ্যে চাহিদা বাড়লে বাহির থেকে দুধ কিনে এনে বিক্রি করি। প্রতিদিন গড়ে ১২০-১৫০ লিটার দুধ বিক্রি হয়। যাতে আমার সংসার চলে।’
সকালে শুরু হওয়া এই বাজার নয়টা বাজতে বাজতেই সব বিক্রেতারা চলে যান। আর স্থায়ী দোকানপাট খোলার আগেই চসিকের লোক এসে পরিষ্কার-পরিছন্ন করে দিয়ে চলে যান। এছাড়া অস্থায়ী বাজার উঠে যাওয়ার পর ভ্যানগাড়িতে করে অবিক্রিত সবজি-মাছ নিয়ে যাওয়া হয় অলি-গলিতে।
এদিকে জামালখান ছাড়াও প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নগরীর নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দির সড়কেও বসে অস্থায়ী বাজার। এই বাজারে ফ্রেশ জিনিসপত্র পাওয়া যায়। এছাড়া নগরীর রাজাপুকুর লেইন, সদরঘাট, ষোলশহর রেল গেট, মোহরা কামাল বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বসে দুই-তিন ঘণ্টার অস্থায়ী বাজার। প্রথমত সদ্য আনা সবজি-মাছ, দ্বিতীয়ত হাতের কাছে পাওয়ায় ক্রেতাদের ভিড় থাকে এসব বাজারে। অনেকে ভিড় এড়াতে এই অস্থায়ী বাজারকেই প্রথম প্রায়োরিটি দেন।
একই চিত্র দেখা গেছে রাজাপুকুর লেইন, আন্দরকিল্লা, চকবাজার এলাকায়। দাম এদিক-সেদিক হলেও রেয়াজউদ্দিন বাজার, কাজীর দেউড়ি বাজারের চাইতে এসব অস্থায়ী বাজারে গিয়ে সবজি-মাছ কিনতেই আগ্রহ বেশি ক্রেতাদের।
পূর্বকোণ/ইবনুর