চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

খোঁজ মিলেছে পরিবারের, বিমল ফিরবেন বাসায়
মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধকে উদ্ধার করে সেবা-শুশ্রূষা দিয়েছেন একদল তরুণ

ফেসবুক পোস্টে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরলেন বৃদ্ধ

তাসনীম হাসান

১৪ আগস্ট, ২০২৫ | ১২:০৬ অপরাহ্ণ

জীর্ণশীর্ণ শরীর। সারাগায়ে পচনের গন্ধ। চোখে নিভে আসা আলো। কথা বলার শক্তিও নেই। মলিন এক বালিশে মাথা রেখে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছেন মাটির ওপর। না আছে খাবার, না কোন যত্নের স্পর্শ। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে শুধুই যেন সময়ের সঙ্গে লড়ে যাওয়া। সবমিলিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত প্রাণ এক। চট্টগ্রাম নগরীর দুই নম্বর গেটে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচে জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে থাকা এই বৃদ্ধ এভাবেই পড়ে ছিলেন বহুদিন। চলতি পথে এক তরুণের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে সেই নিঃশব্দ মৃত্যুপ্রহর। মুঠোফোনের ক্যামেরায় ওই দৃশ্য বন্দী করে তিনি দেন চট্টগ্রামভিত্তিক ‘ডেসপারেটলি সিকিং চিটাগং’ নামের একটি গ্রুপে। সেটি ছুঁয়ে যায় অসংখ্য হৃদয়কে। এরপর শুরু হলো এক মানবিক গল্প। একঝাঁক তরুণ এগিয়ে এলেন, সযত্নে তাকে মাটি থেকে তুলে করলেন পরিষ্কার। শেষমেশ ওই বৃদ্ধকে পৌঁছে দিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে; এক বৃদ্ধাশ্রমে।

 

ইশান সাগর নামের এক তরুণ ওই বৃদ্ধের ছবি ফেসবুকে দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে নেওয়ার জন্য সহযোগিতা চেয়েছিলেন। সময়টা ছিল গত সোমবার দুপুর ১২টা। সেই পোস্ট দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বৃদ্ধের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেন। সেই ভিড়ে ছিলেন ‘স্মাইল বাংলাদেশ’ নামের একটি মানবিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তরুণেরাও। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জয় অন্যদের নিয়ে ওইদিন রাতেই যান ঘটনাস্থলে। তবে বৃদ্ধ নড়াচড়া আর কথা বলতে না পারায় রাতে তাকে সরানো জটিল হয়ে পড়ে; তাই তারা পরদিন সকালে আবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর গত মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে গিয়ে ওই বৃদ্ধকে উদ্ধার করেন।

 

বাকিটা শোনা যাক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জয়ের মুখ থেকেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের পর ওই বৃদ্ধকে আমরা পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে মানবিক শওকতখ্যাত শওকত ভাইয়ের ‘বেওয়ারিশ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে’ নিয়ে যাই। সেখানে ওনার থাকা-খাওয়া-চিকিৎসাসহ সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

এমন কাজে এগিয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে জয় বলেন, আমার বাবা নেই; তাই বয়স্ক মানুষের প্রতি একটু বেশিই আবেগ কাজ করে। তবে মানবিক কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এসব কাজে অনেক ঝামেলা থাকে। বিশেষ করে জিডি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। এরপরও এগিয়ে এসেছি; কেননা ভেবেছি আমাদের কষ্টের বিনিময়ে যদি থাকা-খাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় তাহলে জীবনের শেষ সময়ে হয়তো মানুষটি কিছুটা শান্তি পাবেন।

 

উদ্ধারের সময় ওই বৃদ্ধের কাছে পরিচয় জানতে চাইলে তিনি শুধু দুটি বাক্য বলতে পারেন। জানান, তার নাম বিমল দাশ। বাড়ি আনোয়ারায়। বৃদ্ধকে পরিচ্ছন্ন থেকে বৃদ্ধাশ্রমে নেওয়া পর্যন্ত কাজে আরও যুক্ত ছিলেন স্মাইল বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. এহসান, আরিয়ান স্টোরি নামের ফেসবুক পেজের প্রতিষ্ঠাতা মো. আরিয়ান, ফাহিম, রাফি। তাদের সঙ্গে ছিলেন ফেসবুকে ওই বৃদ্ধের ছবি দেওয়া ইশান সাগরও। আর বৃদ্ধকে নিয়ে যাওয়ার সময় এম্বুলেন্স সেবা দেয় আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন।

 

ওই বৃদ্ধকে সবার নজরে আনা ইশান সাগর বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে ফ্লাইওভারের নিচে ওই বৃদ্ধ মানুষটিকে অসুস্থ ও অসহায় অবস্থায় দেখে আমার মনে হয়েছে, ওনাকে সাহায্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমি ছবিটি তুলে তাই ফেসবুকে শেয়ার করেছি, যাতে দ্রæত সাড়া দিয়ে কেউ ওনাকে সাহায্য করতে পারে। স্মাইল বাংলাদেশের ভাইয়েরা ওনাকে উদ্ধার করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

 

এই বৃদ্ধের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছে বলে জানিয়েছেন বেওয়ারিশ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক সাইদুল ইসলাম তৈয়ব। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সড়কে পড়ে থাকায় এই বৃদ্ধের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী তার সেবা করে যাচ্ছি। পরিবারের কাছে ফেরার আগ পর্যন্ত সময়গুলো যেন যত্ন আর ভালোবাসার ছায়ায় কাটে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।

 

সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষেরা এই গোধূলিলগ্নে বিমলের পাশে ছায়ার মতো দাঁড়ালেও যাদের একদিন স্নেহ-মমতায় বড় করেছেন, সেই আপনজনেরা এখনও তাঁর খোঁজ নেননি। রক্তের সম্পর্ক নয়, মমতার বন্ধনই যেন শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে এক মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের প্রকৃত আশ্রয়!

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট