চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

সামুদ্রিক মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক : গবেষণা
গবেষণায় উঠে আসা বিভিন্ন ধরণের প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। ছবি- সংগৃহীত

সামুদ্রিক মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক : গবেষণা

নাজিম মুহাম্মদ

১৪ আগস্ট, ২০২৫ | ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার বিস্তৃত দৃষ্টিনন্দন বালুকাবেলার নিচে লুকিয়ে আছে অদৃশ্য হুমকি মাইক্রোপ্লাস্টিক। দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে পানি, তলানি এবং মাছের পরিপাকতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি প্রথমবারের মতো উঠে এসেছে। কক্সবাজারের রামুতে অবস্থিত বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিবেশগত সমুদ্রবিদ্যা ও জলবায়ু গবেষণা বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুলতান আল নাহিয়ানের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে জানা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের বণ্টন, আকৃতি, রং ও সম্ভাব্য উৎস।

 

বেশি দূষণ এলাকা হচ্ছে কক্সবাজারের নাজিরারটেক, হিমছড়ি, ইনানী, সেন্টমার্টিনের জেটিঘাট এলাকা। এলাকাগুলোতে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্যের দূষণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পাওয়া গেছে। কক্সবাজার উপকূলে সমুদ্রের তলানি, সমুদ্রের পানির উপরিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মাছ এই তিনটি মাধ্যমকে একসঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে এর আগে গবেষণা হয়নি।

 

সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলের দূষণের সামগ্রিক চিত্রে দেখা গেছে মনুষ্য ও প্রাকৃতিক সৃষ্ট পচনশীল ২৫% বর্জ্য তৈরি হয়ে থাকে যার ১৯% মানুষের সৃষ্ট। অপচনশীল বর্জ্য গুলোর মধ্যে ১৮% বাজার ও দোকানপাট থেকে, ২২% বর্জ্য মৎস্য আহরণ থেকে, ৩% চিকিৎসা সামগ্রী বর্জ্য, ৩২% শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করা যায় এমন সব প্লাস্টিকের তৈরি বর্জ্য।

 

ইনস্টিটিউটের সমুদ্রবিদ্যা জলবায়ু গবেষণা বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান আবু শরীফ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-কিবরিয়া জানান, কক্সবাজারে পর্যটকদের আগমন এবং সামুদ্রিক যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ১২০ কিলোমিটার জুড়ে সমুদ্রের পানির উপরিভাগে এবং তলদেশের পলির মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত করার জন্য ১২টি নমুনা স্টেশন নির্বাচন করা হয়েছিল। পানির উপরিভাগের নমুনাগুলো উপকূলীয় রেখার শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে এক কিলোমিটার দূরে এবং তলদেশের পলির নমুনাগুলো এক থেকে দুই কি.মি দূর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। মাছের নমুনাও একই স্থান থেকে স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়।

 

গবেষণায় কক্সবাজারের ১২টি স্থানে সমুদ্রের পানির উপরিভাগ ও তলানি থেকে মাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনায় মোট ২৯৩টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে ২৩৫টি পাওয়া যায় সমুদ্রের পানির উপরিভাগে, ৪৭টি তলানিতে এবং ১১টি মাছের শরীরে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের মাত্রা পানির উপরে সবচেয়ে বেশি।

 

সমুদ্রের পনির উপরিভাগে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে একটি কণার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এগুলো মূলত ফিল্ম (২৩%), ফোম (২১%) ও তন্তু (২১%)। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো আসে পলিথিন ব্যাগ, খাবারের মোড়ক, মাছ ধরার জাল ও টেক্সটাইল থেকে। শাখা নদী ও মোহনায় দূষণ বেশি দেখা গেছে, যা স্থল থেকে আসা বর্জ্যের প্রভাবের কারণে হয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। সমুদ্রের তলানিতে প্রতি ঘনত্বে মাইক্রোপ্লাস্টিকের এক থেকে ১২টি কণার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এখানে সবচেয়ে বেশি ছিল ফোম (২৮%) ও তন্তু (২৩%)। এগুলো সম্ভবত মাছ ধরার নৌকা, ভাসমান ফোম ও প্লাস্টিক দড়ি থেকে সৃষ্ট হয়েছে। তলানি মাইক্রোপ্লাস্টিকের জন্য একটি ‘সিংক’ বা জমাস্থান হিসেবে কাজ করে, বিশেষত যখন বায়োফিল্ম বা সামুদ্রিক মলের সঙ্গে আবৃত হয়ে কণাগুলো ভারী হয়ে তলায় ডুবে যায়।

 

মাছের নমুনায় ১০টি প্রজাতির ৬২টি মাছের ফুলকা ও পরিপাকতন্ত্র পরীক্ষা করে ১১টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা শনাক্ত করা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ফোম (৪৬%) ও তন্তু (২৭%)। বিশেষ করে কার্নিভোরাস প্রজাতির মাছে এ দূষণ বেশি পাওয়া গেছে, যা সমুদ্রের তলদেশে বাস করে এবং তলানি থেকে খাবার সংগ্রহ করে।

 

গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস মূলত মানবসৃষ্ট, মাছ ধরার সরঞ্জাম, পর্যটন, নগরায়ণ ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এই কণাগুলো খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি তৈরি করতে পারে।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দেশের উপকূলীয় এলাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। ভবিষ্যতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ, নীতি প্রণয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট