চট্টগ্রাম সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

জেলবন্দী ছেলেকে লেখা মায়ের চিঠি : বাবা, বুকে সাহস রেখো
কারাগারে বন্দী দিনগুলোতে মায়ের চিঠি ভরসা দিয়েছিল আবদুল্লাহ বিন আয়ুবকে

জেলবন্দী ছেলেকে লেখা মায়ের চিঠি : বাবা, বুকে সাহস রেখো

তাসনীম হাসান

৯ আগস্ট, ২০২৫ | ১২:১৮ অপরাহ্ণ

জুলাই বিপ্লবে মাঠে নামায় আব্দুল্লাহ বিন আয়ুবকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। দুই থানা ঘোরানোর পর চট্টগ্রাম কারাগারই হয় তার ঠিকানা। তখনকার এইচএসসি পরীক্ষার্থী সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ ছেলে জেলে যাওয়ায় ভেঙে পড়েন মা জান্নাতুল ফেরদৌস। তবে সেটি ছেলেকে বুঝতে দেননি একটুও। ছেলে যখন জেলের চার দেয়ালে বন্দী তখন তাকে সাহস জোগাতে মা লেখেন চিঠি। টানা ১৫দিন সকল যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছেলে সেই চিঠি পেয়ে পান ভরসা। তবে মায়ের চিঠিতে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গুলি-খুনের বিষয়ে জানতে পেরে মনটা ভারও হয়ে যায় তার।

 

সম্প্রতি মায়ের হাতে লেখা দুই পাতার চিঠিটি ফেসবুকে দেন আবদুল্লাহ বিন আয়ুব। মায়ের সেই চিঠিতে ওঠে আসে জুলাই বিপ্লবের অস্থির সময়। সেই চিঠি নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, এমন মায়েরা সন্তানদের পাশে ছিলেন বলেই-জুলাই বিপ্লব সফল হয়েছে।

 

আটক হওয়ার সেই দুঃখদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আবদুল্লাহ বিন আয়ুব। বলেন, ‘দিনটি ছিল ১৭ জুলাই সকাল ছয়টা। হঠাৎ বাসার দরজায় কড়া নাড়ে পুলিশ। এসেই বলতে থাকেন আবদুল্লাহ কে? আমি সামনে আসার পর বলে, ‘মোবাইলটা নিয়ে আসো।’ সেই মোবাইল ঘেঁটে আন্দোলনের বিষয়ে ফেসবুকে লেখা আমার কয়েকটি পোস্ট তারা দেখতে পান। সেগুলো নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে করতে রুমগুলোতে তল্লাশি শুরু করে। তখন দুটি সাধারণ ইসলামিক বই পায়। এরপর আমাকে চকবাজার থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ৬-৭ ঘণ্টা রাখার পর নেওয়া হয় পাঁচলাইশ থানায়। এরপর সোজা আদালত হয়ে কারাগারে।’

 

মূলত ১৬ জুলাই দুই নম্বর গেট-মুরাদপুরে হওয়া ছাত্র আন্দোলনে আয়্বু যোগ দিয়েছিলেন। সেখানকার ছবি দেখেই এই তরুণকে টার্গেট করে পুলিশ। তখন হাজেরাতজু ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিলেন আবদুল্লাহ বিন আয়ুব। কিন্তু জেলে যাওয়ার পর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তখন স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগও ছিল না। এই কারণে ওই চিঠি পাওয়ার আগ পর্যন্ত আয়ুব জানতেন না পরিবার কেমন আছে? দেশ কোনদিকে যাচ্ছে-সবকিছুই।

 

আয়ুব বলেন, ‘সম্ভবত সারাদেশের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার্থী হিসেবে প্রথম আমিই আটক হয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবে পরীক্ষা নিয়ে টেনশন কাজ করছিল। আর আন্দোলনে অংশ নিতে পারছিলাম না বলেও দুঃখ হচ্ছিল।’

 

আয়ুবের অসহায় অবস্থা দেখে একজন কারারক্ষী তাকে সহযোগিতা করেন। ওই কারারক্ষীই মায়ের চিঠিটা আয়ুবের কাছে পৌঁছে দেন। সেই চিঠির শুরুতে জান্নাতুল ফেরদৌস লেখেন ‘বাবা, তুমি আমাদের জন্য চিন্তা করিও না।’ এরপর লেখেন, ‘জীবন মানেই পরীক্ষা। দোয়াদরুদ পড়ো। একদম ওল্টা-পাল্টা চিন্তা করবে না, সবর কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে আছে।’

 

সে সময় আয়ুবের পরিবার তাকে জামিনের জন্য তিনজন আইনজীবী নিয়োগ করেন। কিন্তু কোনো প্রচেষ্টাতেই জামিন মিলছিল না। সেই দুঃখের কথা তুলে ধরে মা লেখেন, ‘উপরের মহলের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কারও জামিন হবে না।’

 

জান্নাতুল ফেরদৌস যখন চিঠিটা লেখেন, তখন আন্দোলন একেবারে তুঙ্গে। সেই কথা তুলে ধরে এই মা ছেলেকে লেখেন, ‘এখন যাদের ধরা হচ্ছে তাদের অনেক অত্যাচার করা হচ্ছে। নির্বিচারে গুলি করছে। যাকে যেখানে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’

 

মায়ের চিঠি শেষ হয় ছেলেকে ভরসা দিয়ে-‘বাবা, বুকে সাহস রাখো। ইনশাআল্লাহ খুব শিগগির মায়ের কাছে ফিরে আসতে পারবে।’

 

ওই চিঠি লেখার দু’দিনের মাথায় মুক্তি মেলে আয়ুবের। এরপর আন্দোলনে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশের নজরদারিতে থাকায় সেই সুযোগ মেলেনি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরেই আফসোস ফুরায় আয়ুবের। বন্ধুদের নিয়ে উদযাপন করেন সেই মুহূর্ত।

 

আয়ুব পূর্বকোণকে বলেন, ‘প্রবাসী আব্বুর অনুপস্থিতে আম্মু যেভাবে সবকিছু ম্যানেজ করেছিলেন, আমার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য লাগে। আম্মুর অনুপ্রেরণাতেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। জেলে যখন কষ্টের দিন যাচ্ছিল, তখন আম্মুর চিঠিটাই আমাকে সুস্থ করে তোলে।’

 

মায়ের সেই চিঠিটি ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই বলছেন-রাজপথে যখন ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরছিল, তখন তাদের সঙ্গে ছিলেন এমন মায়েরা। যারা চোখে জল লুকিয়ে সন্তানদের হাতে দেন সাহসের অস্ত্র। সেই সাহসে ভর করেই তো এলো ‘জয়’।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট