
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি মাঠে বসা বৃক্ষমেলায় প্রবেশ করতেই হাতের বা দিকে চোখে পড়ে ‘জান্নাত শপ’ নামের নার্সারি। সেই নার্সারির হাজারো ছারাগাছের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক নিঃশব্দ ‘বৃদ্ধ’। বয়স তার ৪৪ বছর। তবে বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েনি সে, বরং ছোট্ট এক পাত্রে, খর্ব গড়নে সে অবিচল রাজকীয় গাম্ভীর্যে। নাম তার ‘চায়নিজ বট’।
নার্সারির মালিক বনসাই শিল্পের এই অনুপম নিদর্শনের দাম নির্ধারণ করেছেন এক লাখ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা! কিন্তু এই গাছের মূল্য কি কেবল টাকায় মাপা যায়? এর পাতার কোল ঘেঁষে যে সময় জমে আছে, শিকড়ের গিঁটে গিঁটে যে লেগে আছে চার দশকেরও বেশি ধৈর্য আর নিঃশব্দ সাধনার গল্প। সবমিলিয়ে এ যেন এক-ক্ষুদ্রপাত্রে মহাকাব্যে!
বৃক্ষমেলার সবচেয়ে দামি গাছের স্বীকৃতি পাওয়া এই বনসাই দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গত শুক্রবার বিকেলে বৃক্ষমেলায় দেখা যায়, চায়নিজ বট-নামের ওই বনসাইটির চারপাশে মানুষজনের জটলা। কেউ ভিডিও করছিলেন, কেউবা তুলে রাখছিলেন ছবি।
জান্নাত শপের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আতওয়াবুল ইসলাম যখন এই বনসাইটির কথা বলেন, তার কণ্ঠে ধরা পড়ে এক ধরনের গর্ব আর মমতার মিশ্রণ। এই তরুণ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, এটি একটি চায়নিজ বট প্রজাতির বনসাই। এই গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম- ফাইকাস লঙ্গিফুলিয়া। ১৯৮১ সালে আমার মামারা এটি বনসাই করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে তারা সেটির যত্ন নিতে থাকেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে আমি নার্সারির সঙ্গে যুক্ত হই, এরপর মামাদের হাতে গড়া সেই বনসাইটি আমার কাছে আসে। এরপর থেকে এটার পরিচার্যা করে আসছি।
বনসাইটি নিয়ে বেশ সাড়া পাচ্ছেন বলে জানিয়েছিলেন আতওয়াবুল। বলেন, গত বছরের বৃক্ষমেলায়ও বনসাইটি নিয়ে এসেছিলাম। তখন এটি প্রায় বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, কথাবার্তা একপ্রকার চূড়ান্ত হয়েছিল। তবে তখন দেশের পরিস্থিতি খারাপ থাকায় পরে আর বিক্রি হয়নি। এবারও একজন বিক্রির আগ্রহ দেখিয়েছেন। দেখা যাক, সময় তো আরও আছে।
মেলায় অন্যান্য নার্সারিগুলোও তাদের তৈরি বনসাই নিয়ে এসেছে। বেশিরভাগ বনসাই-বট গাছের তৈরি। তবে অন্যান্য গাছের বনসাইও আছে। আরএনজে নার্সারি নামের একটি নার্সারি একটি চন্দন গাছের বনসাই নিয়ে এসেছে। নার্সারি মালিক প্রবাল সেন বাপ্পী বলেন, এই বনসাইটি ছয় বছর বয়সী। এর দাম নির্ধারণ করেছি আট হাজার। সবুজ মেলা নামের আরেকটি নার্সারিও বট গাছের বনসাই নিয়ে এসেছে। তবে এটির ছয় বছর হওয়ায় দামও অনেক কম-১৫০০ টাকা।
বাংলাদেশ নার্সারি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দুটি চাইনিজ বটের বনসাই নিয়ে এসেছে। তবে এগুলো আরেকটু বয়সী। ১২ বছরের এই বনসাই দুটির একটির দাম ১২ হাজার ও আরেকটির দাম ৮ হাজার বলে জানান এই নার্সারির কর্মী মোহাম্মদ সাইফুল।
তবে এসব বনসাই তৈরির প্রক্রিয়া যে কতটা ধৈর্য ও নিষ্ঠার দাবি রাখে, তা বলে গেলেন নার্সারির মালিকেরা। তারা জানান, বনসাই তৈরি করা একটি সাধনার মতো। এর জন্য শুরুতে উপযুক্ত গাছ নির্বাচন করতে হয়, যা ছোট পাত্রে জন্মানোর জন্য উপযুক্ত। এরপর গাছের শিকড় ছাঁটাই করে, ডালপালা ছেঁটে তার দিয়ে বেঁধে একটি নির্দিষ্ট আকারে আনতে হবে। নিয়মিত পানি দেওয়া, সার দেওয়া সঠিক আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধৈর্য ও সঠিক জ্ঞান।
১৫ দিনের এই মেলায় এবার ২ হাজার ৬৫ প্রজাতির চারা এবং ২১০ প্রজাতীর দেশি-বিদেশি ক্যাকটাস প্রদর্শিত হচ্ছে। টানা বৃষ্টির কারণে ২৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই মেলায় দর্শনার্থীর ভিড় তেমন একটা নেই। সেজন্য একদিকে বেচাবিক্রি কম, অন্যদিকে বৃষ্টির কারণে চারাগাছ নষ্ট হওয়ায় নার্সারি-মালিকদের মুখে হাসি উধাও। তবে ক্রেতার সংখ্যা কম থাকলেও বন্ধুরা দলবেঁধে ঘুরতে আসছে মেলায়। আর ফেরার সময় স্মৃতি হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন-ছোট ছোট অসংখ্য শেকড়ে ভর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা বনসাইয়ের সঙ্গে তোলা একটা ছবি!
পূর্বকোণ/ইবনুর