চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

হাঁস-মুরগি পালন ও সবজি চাষ করতে চান ধনপতিরা

পাউবোর উদ্ধার করা ১১৭ একর জমিতে

হাঁস-মুরগি পালন ও সবজি চাষ করতে চান ধনপতিরা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

৩০ জুলাই, ২০২৫ | ১:১৪ অপরাহ্ণ

উত্তর কাট্টলী এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি দখল করে দীর্ঘদিন ধরে গাড়ির গ্যারেজের ব্যবসা করে আসছিলেন কোরবান আলী। গত সপ্তাহে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে প্রায় দেড় শ একর জমি দখলমুক্ত করেছে পাউবো। এতে উচ্ছেদ করা হয় কোরবানির গ্যারেজও। কোরবান আলী এখন আর অবৈধভাবে থাকতে চান না। এবার বৈধভাবে ইজারা নিতে চান তিনি। তবে এবার গাড়ির গ্যারেজ নয়, বনায়ন ও মৌসুমি শাক-সবজির চাষ করতে চান তিনি। শুধু কোরবান আলী নন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্ধার করা জমি ইজারা পেতে আবেদন করেছেন প্রভাবশালীরা। যাদের অনেকেই পুরোনো দখলদারের তালিকায় ছিলেন। এসব জমিতে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, গাড়ির গ্যারেজসহ পাকা ও স্থায়ী স্থাপনা ছিল। ইজারা পেতে আগ্রহী ২০-২২ জনের আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইট-কংক্রিটের ভারী ব্যবসার বদলে সবাই এখন গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খামার এবং শাক-সবজির চাষাবাদ করতে চান প্রভাবশালী ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা।

কোরবান আলী গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘আবেদন এভাবে লিখতে বলেছেন। সংশোধন করে দেব।’ পরে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলে লাইন কেটে দেন।

 

গত সপ্তাহে কাট্টলী ও হালিশহর এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ১১৭ একর জমি অবৈধ দখলমুক্ত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৩৯ প্রভাবশালী দীর্ঘদিন ধরে এসব জমি দখল করে রেখেছিলেন। অবৈধ দখলদারের মধ্যে সাবেক সিটি মেয়র, সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও ছিলেন।

 

পাউবো সূত্র জানায়, অভিযান চালিয়ে ১১৭ একর জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে। ওই মৌজায় প্রতি শতক জমি ১০-১১ লাখ টাকায় বেচাকেনা হয়। গড়ে ১০ লাখ টাকা করে হলেও উদ্ধার করা জমির মূল্য দাঁড়ায় ১১৭০ কোটি টাকা।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-১) শওকত ইবনে সাহীদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘উদ্ধার করা জমিতে বনায়ন ও পরিবেশবান্ধব পার্ক করার পরিকল্পনা রয়েছে।’ তিনি বলেন, এই এলাকায় তিনটি খাল দখল ও ভরাট হয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। এসব খাল পুনরুদ্ধার করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে সৌন্দর্যবৃদ্ধি, নগরবাসীর পর্যটনকেন্দ্র ও জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে।

 

চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ১৯৭০ সালে ২ হাজার ৬৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল পাউবো। বাঁধ-কাম সড়ক নির্মাণের পর বিপুল পরিমাণ জায়গা অব্যবহৃত রয়ে যায়। পরবর্তীসময়ে তা দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা।

 

হাঁস-মুরগির খামার ও সবজি চাষ : পানি উন্নয়ন বোর্ডের দখলদারমুক্ত করা জমি ইজারা পেতে আবেদন করেছেন অনেকেই। পূর্বকোণের হাতে ২০-২২টি আবেদনপত্রের কপি রয়েছে। এরমধ্যে সম্প্রতি উচ্ছেদ করা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ইয়ার্ড, গাড়ির গ্যারেজ, সাবেক মন্ত্রী, প্রভাবশালী নেতা ও পাকা স্থাপনার মালিকেরাও আছেন। এসব আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, গাড়ির গ্যারেজসহ ভারী স্থাপনা নয়, ইজারা পেলে গবাদি পশুর ও হাঁস-মুরগির খামার এবং মাছ চাষ করতে চান তারা।

ইজারার আবেদন করেছেন মো. মঈন উদ্দিন চৌধুরী ও সাদ্দাম হোসেন নামে দুই ব্যক্তি। দুই দশমিক ৩৬ একর ও দশমিক ৬০ একর জায়গা ইজারা নিয়ে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খামার করতে ইচ্ছুক তারা। মঈন উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘গরু ও হাঁস-মুরগির খামার করার ইচ্ছে রয়েছে।’ ইয়ার্ড ও গ্যারেজের জায়গায় কীভাবে খামার করবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হাঁস-মুরগি না হলেও গরুর খামার করা যাবে।’

রাজনৈতিক এক প্রভাবশালী পরিবারের ৫ ভাই ইজারা পেতে আবেদন করেছেন। দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন ১৭ দাগে চার দশমিক ৫০ একর জমি লিজ পেতে চান তারা। আবেদনে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদি লিজ পেলে মৎস্য চাষ, পশু ও হাঁস-মুরগি পালন করতে আগ্রহী এ বড় ব্যবসায়ী পরিবার।

প্রায় ২১ গন্ডা জমি ইজারা পেতে আবেদন করেছেন মো. আবু সাইদ মুক্তা। তিনিও বনায়ন ও শাক-সবজির চাষাবাদ এবং অন্যান্যভাবে ব্যবহার করতে চান। মো. আরফাত হোসেন নামে এক ব্যক্তি ২২ দিয়ারা দাগের ২ দশমিক ৩০ একর জায়গা ইজারার জন্য আবেদন করেছেন। তিনিও আমিষের ঘাটতি পূরণে পশু ও হাঁস-মুরগি পালন করতে চান।

কৃষির আড়ালে শুভঙ্করের ফাঁকি :

কৃষি লিজের আড়ালে শুভঙ্করের ফাঁকি বলে জানিয়েছেন পাউবোর কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে দখল করা জমিতে ভারী ব্যবসা-বাণিজ্য চলে আসছিল। অনেকেই দখল করা জায়গায় কোটি কোটি টাকার ভাড়া দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজস্ব শাখা সূত্র জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থাবর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নির্দেশনা-২০১৭ মতে, কৃষি লিজের ক্ষেত্রে প্রতি শতকের বিপরীতে ৫০ হাজার টাকার জামানত ও ৪ হাজার টাকার ভাড়া নির্ধারণ রয়েছে। আর বাণিজ্যিক লিজের ক্ষেত্রে শতকপ্রতি ৯০ হাজার টাকার জামানত ও ৯ হাজার টাকার ভাড়া গুনতে হবে। বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিতে আবেদনকারীরা কৃষি লিজের আবেদন করেছেন। অথচ আবেদন করা জায়গায় আগের দখলকারীরা ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, গাড়ির গ্যারেজ, পাকা স্থাপনাসহ বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করেছিল।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, ‘উদ্ধার করা জমি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। নিজেদের ব্যবহারের পর অবশিষ্ট জমি ইজারা দিলে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব পাবে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট