
কি, শিরোনাম দেখে চমকে উঠলেন? উঠারই কথা। এ কেমন শিরোনাম? এক টুকরো ইলিশ সমান এক কেজি রুই মাছ। বিষয়টা কেমন জানি গোলমেলে লাগছে, তাইতো। চলুন, গল্পটা বলি- এটা গল্প নয় নিরেট সত্য।
আকমল (ছদ্মনাম) সাহেব। প্রতিদিন সকালে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে টুকটাক বাজার করে ঘরে ঢোকেন। ঘরের গিন্নি প্রায়দিন বলে- ইলিশের সিজনতো চলে যাচ্ছে, একবারও ইলিশ খেতে পারলাম না। তবে আকমল মনে মনে ভাবেন ইলিশ কি আর সাধে কিনি না, বাজারে ইলিশের দামে যে আগুন, সে বিষয়টা তোমায় বুঝাই কেমনে? যা হোক, স্কুল থেকে ফেরার পথে নগরীর জামালখান সিঁড়ির গোড়ায় বিক্রি করতে আনা অল্প ইলিশ দেখে মন ভরে গেলো। সাইজটা বড়জোর ৪৫০-৫০০ গ্রাম (প্রতি ইলিশ)। তার মানে এক কেজিতে ২টার বেশিও ধরবে। দাম ১১০০-১২০০ টাকা। দাম শুনে নেয়ার সাধ মিইয়ে গেল। বিষাদ মনে সিঁড়ির গোড়া দিয়ে নেমে আসতেই কুসুমকুমারী সিটি করপোরেশন স্কুলের অপোজিটে কিছু সামুদ্রিক মাছ ও ২টা ইলিশ (দেড়-দুইকেজি) চোখে পড়ল। ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করেই চোখ ছানাবড়াÑ এক দাম ৩৩০০/- (প্রতিকেজি)। আবারও মনে পাথর চাপা দিয়ে কিছু না বলে হাঁটা দিলাম। দরদাম করলে হয়তো কিছুটা কমানো যেত। সোজা হাঁটতে হাঁটতে ভাবলামন্দ হয়তো, জামালখান এরিয়ায় সব বড়লোক থাকে; তারা মনে হয় এই দামেই ইলিশ খায়। না হলে, যে সামান্য ইলিশ বাজারে দেখা যায় তা কিনে কারা? আর যদি এই ইলিশ মাছ প্রতিকেজি তিন হাজার টাকায়ও কেনা হয়, তাহলে এক টুকরোর দাম পড়ে ৩০০ টাকা। কারণ এক কেজিতে মাথা-লেজসহ ১০ টুকরোর বেশি হওয়ার কথা নয়। তাই ওই তিনশ টাকায় এক কেজির একটা রুইমাছ আর এক আঁটি পুইশাক নিয়ে বাসায় চলে আসলেন।
উপরের গল্পটা শুধু আকমল সাহেবের নয়, পুরো মধ্যবিত্ত পরিবারের। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রধান ঝামেলাÑ তারা সারাবছরই আর্থিক টানাপোড়েনে থাকেন। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। পান্তা ফুরাবার এই সময়ে ইলিশ মাছ খাওয়া এক ধরনের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাস ইলিশের ভরা মৌসুম হিসেবে ধরেন জেলেরা। ভরা মৌসুমেও বাজারে মিলে না ইলিশ। সরবরাহ কম থাকায় বাজারে ইলিশের সংকট রয়েছে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইলিশের দাম হাঁকানো হয় আকাশচুম্বী। অনেক আগেই মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে ইলিশ। এখন বাড়তি দাম দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। ইলিশ পাতে তোলাই যেন এক রাজকীয় কারবার।
নগরীর প্রায় বাজারে আগে ইলিশের মৌসুমে ইলিশের দেখা মিললেও এখন কম দেখা যায়, আবার দেখা গেলেও তা প্রচুর দাম থাকে। যা সাধারণ মানুষের দ্বারা কেনা সম্ভব নয়। আবার যারা কিছুটা শখ করে বছরে দু-একবার ইলিশ কিনে, তারা হয়তো কেজিতে দুটো বা আরও ছোট সাইজের ইলিশ কিনে সন্তুষ্ট থাকে। তাহলে প্রশ্ন হলোÑ ইলিশ কি কম পাওয়া যাচ্ছে, আর যদিও কম পাওয়া যায়; তাহলে এতো পরিকল্পনার পরেও কেনো কম পাওয়া যায়? আর যদি প্রতিবছরের মতো ইলিশ ধরা পড়ে তাহলে এই মাছ যায় কোথায়?
আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের ভাষ্য : দেওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী রিদোয়ান বলেন, ‘ইলিশ মাছ আনলেও মানুষ ইলিশ মাছ নেয় না। কারণ দাম বেশি হওয়ায় তারা কিনতে পারে না। আমরাও আড়ত থেকে বেশি দামে কিনে আনি, তাই কম বিক্রি করা যায় না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আড়তদার জানান, বৈরি আবহাওয়ার কারণে জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারছে না। ফলে বাজারেও তার প্রভাব পড়েছে। মূল কথা নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। নদীতে ইলিশ না পাওয়া গেলে জেলেরা কোথা থেকে পাবে।
মাছ ব্যবসায়ীদের দাবি : মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, একটি ট্রলার পাঠাতে অনেক খরচ। জ্বালানি তেলের দাম বেশি। একটি ট্রিপে যে খরচ হয়, সে তুলনায় ইলিশই পাওয়া যায় না। ফলে দাম কমছে না। তবে দু’এক সময় কোনো ট্রলারে হয়তো অনেক বেশি মাছ পাওয়া যায়। যদি কোনো ইলিশের ঝাঁক একবারে জালের নিচে পড়ে, তাহলেই হয়তো লাভের মুখ দেখা যায়। কিন্তু সেটা সার্বিক চিত্র না। আর তা দিয়ে বাজারে দাম কমে না।
বাজারে ক্রেতাদের ক্ষোভ : বাজারের ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া মাছের কেন এত দাম হবে? এ মাছে চাষের খরচ নেই। নেই ফিড বা মেডিসিনের। তারপরও নদী বা সমুদ্র থেকে জাল টেনে ধরে আনা ইলিশের দাম মাংস থেকেও অনেক বেশি। তাহলে তা কি আমাদের মতো মধ্যবিত্তের পক্ষে কেনা সম্ভব? এটা হয়তো আমাদের এক সপ্তাহের মাছ-মাংসের খরচ। তাই ইলিশ খেতে হলে এখন আয়োজন করে খেতে হয়। এভাবে চললে হয়তো আমাদের জাতীয় মাছ যে ইলিশ, তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে যাবে।
ইয়াসিন আরাফাত নামে বেসরকারি ব্যাংকের আরেক ক্রেতা বলেন, ‘এ বছর মাছের দাম বাড়তি দেখা যাচ্ছে। ইলিশের দাম বাড়তি দেখে অন্য মাছ নিয়েছি। তবে ইলিশ বুঝি সত্যিই এবার মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেল। বষা মৌসুমে এসে ইলিশের এত দাম।’
ইলিশের দরদাম : নগরীর কয়েকটা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম এখন ২০০০-২৫০০ টাকা, দেড় কেজি ২৫০০-৩০০০টাকা। ছোট ইলিশের মধ্যে ৮০০ গ্রামের ইলিশের দাম ১৫০০-২০০০ টাকা, ৭০০ গ্রাম ১২০০-১৫০০ টাকা, ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামের ইলিশ ১০০০-১২০০ এবং ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ৮০০-১০০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। বাজার অনুযায়ী মাছের দাম ভিন্ন হতে পারে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানা যায়, পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশের অধিক ইলিশ উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইলিশের দেশ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। ‘বাংলাদেশ ইলিশ’ শীর্ষক ভৌগোলিক নিবন্ধন সনদ (জিআই সনদ) প্রাপ্তিতে নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ইলিশ সমাদৃত। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত মাছের ১২ শতাংশ আসে শুধু ইলিশ থেকে, যা দেশের জিডিপির এক শতাংশের অধিক। ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ দশমিক ৬৭ লাখ টন। যা গত ২০১০-১১ অর্থবছরের (৩.৪০ লাখ টন) চেয়ে ৬৬.৭৬ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ২৭৬ কোটি ২৯ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিগত সরকার। তবে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ইলিশের সরবরাহ সংকট কাটছে না। ইতোমধ্যে প্রকল্পটিতে খরচও হয়ে গেছে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইএমইডি। প্রধান কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে তদারকি সংস্থা আইএমইডি। সম্প্রতি প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
আইএমইডি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, প্রকল্প শুরুর ৪ বছর ১০ মাস পার হলেও চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৫৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যা ৯০ শতাংশেরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। প্রকল্পের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) সংস্থান অনুযায়ী ২৭৬ কোটি ২৯ লাখ টাকার বিপরীতে খরচ হয়েছে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। বাকি কাজ এ সময়ে শেষ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছে আইএমইডি।
পূর্বকোণ/পিআর