
তাদের কারও মা নেই, কারও বাবা। কারও বা দু’জনের কেউই নেই। অবহেলা-অনাদরে এই শিশুরা বেড়ে উঠছে এতিমখানার চার দেয়ালে। দুর্গম পাহাড়ের এক কোণায় গড়ে ওঠা এসব এতিমখানা শহর থেকে দূরে হওয়ায় তেমন সহযোগিতাও মেলে না। বেশিরভাগ শিশুকেই তাই এক তরকারিই খেতে হয় তিনবেলা। তাদের জীবনের রঙটুকু যেন ফিকে হয়ে গেছে ভাত আর পাতলা ডালের মাঝে। সেই সব শিশুর মুখে মাঝে মাঝে মুরগি পোলাও-বিরিয়ানি তুলে দিয়ে হাসি ফোটাচ্ছেন কিছু তরুণ।
শিশুদের পেট পুরে খাইয়ে আনন্দ পাওয়া এই মানুষগুলো যুক্ত আছেন-‘স্মাইল বাংলাদেশ’ নামের একটি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে। এই সংগঠনের নেই কোনো কর্পোরেট ফান্ডিং, নেই বিশাল কোনো অফিসও। আছে শুধু একদল মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। নিজেদের চাঁদায় চলে তাদের পথচলা। অবশ্য তাদের এই কর্মসূচিতে যুক্ত হন আরও অনেকেই। তারা কারো জন্মদিন, কারো বিয়ের খরচ কিংবা আকিকার খরচের অংশ দেন এই সংগঠনকে। সেই টাকায় এই তরুণেরা অসহায় শিশুদের জন্য সাজান খাবারের টেবিল। তারা এই প্রকল্পের নাম দিয়েছেন-‘এক বেলা আহার।’
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘সীতাকুণ্ড ছিন্নমূল পাথরিঘোনা হুসাইনিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা’র ১০০ শিশুর জন্য খাবার আয়োজনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল এই প্রকল্প। সেই শুরু। এখন পর্যন্ত ২৮৫টি ইভেন্টের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি শিশুর মুখে এই সংগঠন তুলে দিয়েছে একবেলা সুস্বাদু খাবার।
এক বেলা আহারের প্রকল্পটি চার বছর আগে শুরু হলেও এক যুগের বেশি সময় ধরে স্মাইল বাংলাদেশ বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে মানবিক কাজ করে আসছে। ২০১২ সালে চালু হওয়া এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জয় ছোটকাল থেকেই দেখেছেন সমাজের অসহায় মানুষদের দুঃখ-কষ্ট। খাবারের কষ্টে শিশুদের কান্নাও দেখেছেন। সেসব দেখেই মনের ভেতর একটা স্বপ্নের বীজ বুনে দেন জয়। সেটি হলো-বড় হলে মানুষের জন্য কিছু করবেন। সেই গল্প মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জয় খুলে বলেন দৈনিক পূর্বকোণের কাছে। তিনি বলেন, ‘সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না অনুভব করে আসছিলাম শৈশব থেকেই। বড় হয়ে নিজের কিছুটা সামর্থ্য হওয়ার পর আরও বেশ কয়েকজন শুভাকাক্সক্ষীকে নিয়ে ২০১২ সালে স্মাইল বাংলাদেশ নামের সংগঠনটি চালু করি। সংগঠনের বয়স বাড়তে বাড়তে আমাদের পরিধিও বাড়ছে। এখন আমরা ১৫০ জনের পরিবার। আমরা সবাই নিজেদের চাকরি-পড়াশোনার অবসরে চেষ্টা করে যাচ্ছি মানবিক কাজ করার।’
এক বেলা আহার-প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন নজরুল ইসলাম। বলেন, ‘দুর্গম পাহাড়ি এলাকার ১০টি এতিমখানায় আমরা নিয়মিত খাবার দিই। এই এতিমখানাগুলো শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় তেমন সহযোগিতা পায় না। বেশিরভাগ সময়ে তাই শিশুদের এক তরকারি দিয়ে তিনবেলা খাবার খেতে হয়। এসব দেখে আমরা এই প্রজেক্টের মাধ্যমে চেষ্টা করি শিশুদের মুখে একবেলা ভালো খাবার তুলে দিতে। তাদের পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন এতিমখানা ও পথশিশুদেরও আমরা খাবার দিই। ভালো খাবার পেয়ে এই শিশুরা যখন হাসে, তখন মনে অন্যরকম শান্তি লাগে।’
শিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থার পাশাপাশি স্মাইল বাংলাদেশ আরও নয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ত্রিশ মিনিট স্কুল ক্যাম্পেইন, স্মাইল স্কুল, রক্তদান, জরুরি ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৩২ জনের একটা কমিটি আছে সংগঠনটির। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন আরও প্রায় দেড়শ সদস্য। সদস্যদের মাসিক ১০০ টাকার চাঁদাতেই বেশিরভাগ মানবিক ও সামাজিক কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ইভেন্টে সদস্যরা সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়ান। এছাড়া অনেক শুভাকাক্সক্ষীর অনুদানেও এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। কোথাও খাবার দেওয়ার আগে স্মাইল বাংলাদেশের ফেসবুক পেজে পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয় ‘আপনাদের পরিবারের কারো জন্মদিন, আকিকা, মৃত্যুবার্ষিকী, কারো বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান থেকে একটি অংশ এতিমখানা কিংবা পথশিশুদের জন্য ডোনেট করুন।’ সেই পোস্ট দেখে এক বেলা আহার-প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন অনেক সামর্থ্যবান মানুষ।
কেউ কেউ উৎসবের খরচ বাঁচিয়ে শিশুদের জন্য খাবার তৈরি করে পাঠান। কেউ বা অর্থ পাঠান খাবার আয়োজনের জন্য। খাবার প্রস্তুতের জন্য স্মাইল বাংলাদেশের ১২ জনের একটি দল আছে, যারা নিজেরা বাজার থেকে খাদ্যপণ্য সংগ্রহ থেকে রান্না সবকিছুই করেন।
তরুণদের আরও স্বেচ্ছাসেবী কাজে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান স্মাইল বাংলাদেশের পরিচালক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্বেচ্ছাসেবী কাজে শুধু মানুষের উপকার হয় না, পাশাপাশি এটি তরুণদের ক্যারিয়ার সফলভাবে গড়তে সাহায্য করে। স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের মাধ্যমে অর্জিত এসব দক্ষতা পরবর্তীতে চাকরি, ব্যবসা বা অন্য যেকোনো কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা এনে দেয়।
এই খাবার আয়োজন করতে গিয়ে স্মাইল বাংলাদেশের সদস্যদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এতিমখানায় পৌঁছতে খাবার পিঠে নিয়ে দুর্গম পথে হাঁটতে হয়। রান্নার ধকলও সামলাতে হয়। তবে পেট ভরে খাওয়ার পর শিশুরা যখন নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে একটুখানি হাসে, তখনই যেন তাদের সব কষ্ট উবে যায়। আর তখন তাদের হৃদয়ের গহীনে জন্ম নেয় নতুন তাড়না-আরও অনেক অসহায় শিশুর মুখেই তুলে দিতে হবে ‘এক বেলা আহার’।
পূর্বকোণ/ইবনুর