চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

চামড়া শিল্প : সম্ভাবনা সত্ত্বেও চরম অবহেলা
ফাইল ছবি

চামড়া শিল্প : সম্ভাবনা সত্ত্বেও চরম অবহেলা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৬ জুলাই, ২০২৫ | ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

পিতার হাত ধরে চামড়া ব্যবসায় আসেন বোয়ালখালীর সামশুল আলম। পাকিস্তান আমল থেকেই এ ব্যবসায় জড়িত। সেই জৌলুস এখন আর নেই। নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে তার মতো অন্তত দুই শতাধিক ব্যবসায়ী বিপর্যস্ত-দেউলিয়া। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও চামড়াশিল্পের কমপ্লায়েন্স (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অর্জন করতে না পারায় সামশুল আলমের মতো শত শত ব্যবসায়ী কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছেন। অথচ চামড়াশিল্প হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় প্রধান এ রপ্তানিযোগ্য খাত।

 

এই খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, এর বড় সমস্যা হলো, সরকারের উদাসীনতায় ঢাকার সাভারের চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) গুণগতমানের ত্রুটি, আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকা ও বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থাপনায় অবহেলা-দুর্বলতাসহ নানা সমস্যার কারণে বাংলাদেশের চামড়াশিল্প পিছিয়ে পড়েছে। কারণ কমপ্লায়েন্স (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অর্জন করতে না পারলে ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত বিশে^র জুতা তৈরির বড় ব্র্যান্ড বা ক্রেতারা চামড়া কেনেন না।

 

মদিনা ট্যানারির মালিক মালিক হাজি আবু মোহাম্মদ বলেন, ‘আমেরিকা, স্পেন, ইতালি, জাপান, কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা চামড়া রপ্তানি করতাম। পরিবেশ দূষণের নামে সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে চামড়াশিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে।’ গত সরকারের ব্যর্থতা নির্ণয় করে দ্রæত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলে চামড়া খাতের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে মন্তব্য করেন প্রবীণ এ ট্যানারি মালিক।

 

এলডব্লিউজি কী: ২০০৫ সালে নাইকি, এডিডাস ও টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। ইউরোপের বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো এই সনদধারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কারখানা থেকে চামড়া বা চামড়াজাত পণ্য কেনে না।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে অন্তত ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার আয় হারাচ্ছে।

 

চট্টগ্রামে টিকে আছে একটিমাত্র ট্যানারি: পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামে ৩০টি ট্যানারি চালু ছিল। স্বাধীনতার পরও ২২টি ট্যানারি জিইয়ে ছিল। আশির দশকের পর থেকে ধুঁকতে থাকে চট্টগ্রামের চামড়াশিল্প। বর্তমানে টিকে রয়েছে রীফ লেদার নামে একটি ট্যানারি। টি কে গ্রুপের সহযোগী এ প্রতিষ্ঠানটি কালুরঘাটে শিল্পাঞ্চলে ১৯৯১ সালে স্থাপন করা হয়। এখানে কাঁচা চামড়া থেকে ফিনিশড পর্যন্ত কমপ্লায়েন্স (পরিবেশ দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) মেনে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। বাংলাদেশে এলডব্লিউজির সনদ পাওয়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও জুতা রপ্তানি করে আসছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

 

রীফ লেদারের পরিচালক মোখলেসুর রহমান বলেন, এলডব্লিউজি সনদ ছাড়া ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলো চামড়া ও চামড়াপণ্য কিনে না। এ সনদ থাকায় আমাদের অনেক বায়ার (ক্রেতা) রয়েছে। তাই আমরা দর কষাকষি করে প্রতি বর্গফুট চামড়া দেড় ডলারে বিক্রি করতে পারি। অন্যরা অর্ধেক দামও পায় না।

 

চীন নির্ভরতায় বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বাংলাদেশ: ট্যানারিমালিক ও চামড়া ব্যবসায়ী জানান, বৈশ্বিক সনদ না থাকায় বাংলাদেশ চামড়া রপ্তানিতে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চীনা ক্রেতারা ভালো মানের প্রতি বর্গফুট চামড়া ৫০ থেকে ৬০ সেন্টে কিনে। মাঝারি মানের চামড়া কিনে ৪০ থেকে ৪৫ সেন্টে। যা দেশীয় মুদ্রায় প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম পড়ে ৬০-৭০ টাকা। দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিপণ্য চীনা ক্রেতাদের কাছে এভাবে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ থেকে কেনা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে চীন নিজেদের নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। এতে বাংলাদেশ বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

 

ঢাকা ট্যানারিশিল্পের এ বি এস ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখন ৪০ সেন্টে চামড়া বিক্রি করি। কিন্তু সার্টিফিকেশন পেলে আন্তর্জাতিক বাজারে ৩-৪ ডলারেও বিক্রি করা সম্ভব।

 

এলডব্লিউজির সনদধারী চট্টগ্রামের একমাত্র প্রতিষ্ঠান রীফ লেদারের পরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেন, এলডব্লিউজি সনদ থাকায় আমরা দেড়-দুই ডলারে বিক্রি করতে পারি। অন্যরা বাধ্য হয়ে অর্ধেক দামে চীনের কাছে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে।

 

ট্যানারি মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারের উদাসীনতার কারণে বাংলাদেশে চামড়াশিল্পে পিছিয়ে রয়েছে। বৈশ্বিক ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

 

দেড় হাজার কোটি টাকার চামড়া আমদানি : দেশে নিজস্ব কাঁচামালনির্ভর রপ্তানিপণ্যের মধ্যে চামড়া অন্যতম। এটি দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিপণ্য। কিন্তু পরিবেশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মানের প্রশ্ন থাকায় বিশ্ব বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। এখন বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে। এ জন্য বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। দেশের চামড়া গুণগত মানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী জুতা কোম্পানিগুলোকে চীন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চামড়াপণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।

 

এলডব্লিউজির সনদধারী প্রতিষ্ঠান রীফ লেদারের পরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেন, দেশে আরও অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠানের যদি এলডব্লিউজি সনদ থাকত, তাহলে বিদেশ থেকে এত চামড়া আমদানি করতে হতো না। বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হতো না। কমপ্লায়েন্স ছাড়া এ সনদ পাওয়া যায় না।

 

করোনায় বড় ধাক্কা: ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনায় বড় ধস নেমেছিল। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন রাস্তা থেকে দেড় লক্ষাধিক চামড়া কুড়িয়ে নিয়ে ডাম্পিং করা হয়েছিল। পরের বছর (২০২০ সাল) একই অবস্থা হয়েছিল। চলতি বছরও কোরবানির পশু চামড়ায় বিপর্যয় ঘটেছে। নগরীর চামড়ার আড়ত আতুরার ডিপোসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ১৫ হাজার চামড়া সংগ্রহ করে ডাম্পিং করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিল চসিক।

 

৬০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয় কোরবানিতে: সারা বছর দেশে যে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ আসে কোরবানি মৌসুমে। চলতি বছর চট্টগ্রামে ঈদুল আজহায় চার লাখ ১৫ হাজার ৩৫১ পিস পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে গরুর চামড়া তিন লাখ ১৫ হাজার ৩৫১ পিস ও মহিষের চামড়া ১০ হাজার ৫০০ পিস এবং ৫২ হাজার ৫০০ পিস ছাগলের চামড়া।

 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে এবার কোরবানিতে পশু জবেহ হয়েছে ৭ লাখ ৮১ হাজার ৮৩১টি। এরমধ্যে গরু-মহিষ রয়েছে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৪৯০টি। কোরবানির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৮ লাখ ৯৬ হাজার ২৬৯টি।

 

রাঙ্গুনিয়ার মৌসুমী বিক্রেতা নুরুল আবসার কোরবানির দিন বলেছিলেন, পাড়া-গাঁ থেকে ৫২০টি চামড়া কিনে নগরের আতুরার ডিপো আড়তে এনেছিলাম। প্রতিটি চামড়া গড়ে ২০০ টাকার বেশি দরে কেনা পড়ে। কিন্তু বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন।

 

ট্যানারি মালিকদের অভিযোগ, চামড়াশিল্প নিয়ে সরকারের অবহেলার কারণে কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

 

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী-আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, সরকারকে বন্ধ হওয়া ট্যানারি চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে বাজারে প্রতিযোগিতা ও দাম বাড়বে। অন্যথায় চামড়াশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট