
পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা একটি কলোনি। সরু-স্যাঁতসেঁতে আঁকাবাঁকা গলি, যেখানে দু’জন মানুষ পাশাপাশি হাঁটলে গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগে। সেই গলির একেবারে শেষ মাথায় ৬ বাই ১০ ফুটের ছোট্ট একটা সেমিপাকা ঘর। খাট আর আলমারি বসানোর পর সেখানে যেন নড়াচড়ার আর এতটুকু জায়গাও নেই। বাইরে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ, অথচ ঘরের ভেতরটা দমবন্ধ। জানালাবিহীন ঘরটিতে ঢোকে না আলো, আসে না বাতাসও। সেই ‘কুঁড়েঘরেই’ দুই সন্তানকে বুকে আগলে কোনমতে বেঁচে আছেন সীমা আক্তার।
এই ঘর থেকেই গতবছরের ১৬ জুলাই সকালে সর্বশেষ বেরিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে ছুটেছিলেন ফার্নিচার দোকানের কর্মী মোহাম্মদ ফারুক। আর ফিরেননি, আসবেন না কোনদিন। ওইদিন বিকেলে মুরাদপুরে ছাত্রজনতার ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা-গুলি চালায়। সেই গুলিতে প্রাণ যায় ফারুকেরও। এরপর রাতে তারই নিথর দেহ পাঠানো হয় কুমিল্লায় শ্বশুরবাড়ির এলাকায়। সেখানে কবরে চিরদিনের জন্য শুয়ে আছেন ফারুক।
ফারুক ছিলেন না ছাত্র, ছিলেন না কোন দলের কর্মীও। তাই তার আত্মত্যাগ যেন সেভাবে কদর পায়নি মিছিলের ব্যানারে, ড্রোন শোয়ের আকাশে। গতকাল শুক্রবার ফারুকের রেখে যাওয়া সেই নগরীর লালখানবাজার এলাকার ঘরে পা ফেলতেই নিঃশব্দতা ভেদ করে ভেসে এলো স্ত্রী-সন্তানের আফসোস-হাহাকার। টিনের ঘরটি ছোট্ট হলেও সেটিকেই ফারুক আর সীমা বানিয়ে ফেলেছিলেন সুখের নীড়। ছেলে ফাহিমুল ইসলাম আর মেয়ে ফারিয়া আক্তারকে নিয়ে বেশ ভালোই চলছিল তাদের জীবন। কিন্তু ১৬ জুলাইয়ের পর সেই বাসাটি জুড়ে-শুধুই শূন্যতা।
সীমা আক্তার সেই অম্ল-মধুর গল্প শোনালেন, আমার স্বামী ১৭ হাজার টাকা বেতন পেতো। টাকাটা কম হলেও আমাদের হয়ে যেতো। খেয়ে-দেয়ে দুই সন্তানকে পড়াশোনা করিয়ে বেশ ভালোই ছিলাম আমরা। কিন্তু হঠাৎ তার মৃত্যু সব এলোমেলো করে দিলো। আমার জীবন তো শেষ। আমার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎও এখন অন্ধকারে।
ফারুকের স্ত্রী-সন্তান যে বাসাটিতে থাকেন সেই ঘরটিতে নেই কোন শৌচাগার। বাইরে গণশৌচাগারেই সারতে হয় গোসল-কাপড় ধোয়াসহ সবকিছু। ফারুকের স্ত্রী আফসোস করে বলেন, ফারুক বলেছিল এ বছরেই বাথরুমসহ আছে এমন বাসা ভাড়া নেবে। কিন্তু হলো না। আজ সে নেই, আমাদের সাধ থাকলেও সাধ্য মরে গেছে।
ফারুক মারা যাওয়ার পর ২৬৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন তার বাবা মো. দুলাল। তবে এই মামলা নিয়ে ফারুকের স্ত্রী সীমাকে অন্ধকারে রেখেছিলেন দুলাল। স্বামী হারানোর এক বছর পরও সেই দুঃখ ভুলতে পারেননি সীমা। সেই কথা আরেকবার তুলে ধরে সীমা বলেন, ‘ফারুক বেঁচে থাকতেও কোনদিন খবর নিতেন না আমার শ্বশুর। কিন্তু ছেলে মারা যাওয়ার পর তিনি সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সরকার যে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র করে দিয়েছিল, তার অর্ধেক ভাগ নিয়ে বসেন আমার শ্বশুর। অথচ আমার দুই সন্তানকে আজ পর্যন্ত তিনি একবারও দেখতে আসেননি। শুধু তাই নয়, ছেলের লাশ নিয়ে মামলাবাণিজ্যও করেছেন। অনেকজনকে আসামি করেছেন যারা ঘটনাস্থলেও ছিলেন না, আবার টাকা খেয়ে জড়িতদের অনেককে বাদও দিয়েছেন। আমার শ্বশুরের আরও পাঁচটা ছেলে আছে, যারা তাকে দেখাশোনা করে। সেই তিনি দুই সন্তান আর স্ত্রীকে রেখে মারা যাওয়া ছেলের পরিবারের কী দায়িত্ব নেবেন, উল্টো ছেলের রক্ত বেচে টাকা কামাচ্ছেন।’
বাবা কী সেটি ভালোভাবে বোঝার আগেই হারিয়ে ফেলেছে ছোট্ট ফারিয়া। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়ার আগেই মেয়ে স্কুলে চলে যেতো। মোহাম্মদ ফারুক তাই রাতেই মেয়ে ফারিয়া আক্তারকে আদর করে দিতেন। সঙ্গে দিতেন স্কুলে গিয়ে কিছু খাওয়ার জন্য টাকা। এই রুটিনের ব্যত্যয় হতো না কোনদিন। মারা যাওয়ার আগের রাতেও মেয়েকে ঠিক একইভাবে আদর করেছিলেন ফারুক। একদিন যে বাবা মেয়ের হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়েছিলেন টাকা, আর কপালে দিয়েছিলেন চুমু- এখন সেই বাবার হাসিমাখা ছবিটাই দেয়ালে ঝুলে আছে ফ্রেমের ভেতর, নিঃশব্দ আর অচল।
বাবার ছবিটা দেখতে দেখতে ছোট্ট ফারিয়ার মনটা যেন ফের কেঁদে ওঠে, প্রতিদিন রাতেই বাবা আমাকে আদর করতো। মারা যাওয়ার আগের রাতে আমি তার কাছে দুই টাকা চেয়েছিলাম। সে আমাকে চার টাকা দিয়েছিল। সবার বাবা আছে, আমারই শুধু নেই। সবার বাবা ফিরে আসে সন্ধ্যায়। শুধু আমার বাবাই ফেরে না। আমি বাবাকে কী যে মিস করি!
আর অষ্টম শ্রেণিতে পড়া ১৪ বছরের ফাহিমুল? যে বয়সে খেলার মাঠে থাকার কথা, সে এখন বাবাহীন সংসারের নীরব পাহারাদার। তার চোখে এখনও ভাসে বাবার শেষ দৃশ্যটা, সকালে চোখের সামনে জলজ্যান্ত বাবা বেরিয়ে গেলো, আর রাতেই কিনা পেলাম তার লাশ। বাবাকে শেষবারের মতো ভালো করে দেখতেও পারলাম না। কেননা তখন দেখার জন্য আমাদের সময় দেওয়া হয়েছিল শুধু দশ মিনিট।
ফারিয়া আর ফাহিমুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হয়, তাদের ঘরটা ছোট্ট হতে পারে, সেই কুঁড়েঘরের ভেতর যে শোক জমে আছে, তা যেন পুরো পৃথিবীর সমান ভারী!
পূর্বকোণ/ইবনুর