মুজিব জন্মশতবার্ষিকী-২০২০, বঙ্গবন্ধু মৎস্য আড়ত, বঙ্গবন্ধু ফিসল্যান্ড-এই ধরনের পাঁচটি সাইনবোর্ড লিখা ছিল চাক্তাই মাছ বাজারে। আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠেছিল বাজারটি। অথচ ২০১৬ সালে কর্ণফুলী নদীর তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নতুন স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল হাইকোর্ট।
অভিযোগ ছিল, নগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা ও সাবেক মেয়র ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বাজারটি নির্মাণ করেছিল। নদীর তীরের জায়গা সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে ইজারা নিয়ে মাছ বাজারটি নির্মাণ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত জায়গা দখলে নিয়ে বহুতল ভবন ও হিমাগার-বরফকল নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু নোটিশ দিয়ে দায় সেরেছে ইজারা কর্তৃপক্ষ।
দেখা যায়, গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান মাছ বাজারের নিয়ন্ত্রক নগর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বাবুল সরকার এবং তার গডফাদার খ্যাত আলোচিত-সমালোচিত সেই মেয়রও। মাছ ব্যবসায়ী ছাড়াও দোকান বরাদ্দ পেয়েছিলেন সাবেক এক মেয়রের ঘনিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতারা। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর পালিয়ে যান তারা। এখন বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে নতুন সাইনবোর্ড ঝুলানো হয়। আওয়ামীপ্রীতি ঝেরে এখন বিএনপি বন্দনা শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা।
গত মঙ্গলবার বাজারের নিয়ন্ত্রক মৎস্যজীবী লীগের নগর সভাপতি বাবুল সরকারের দুটি মোবাইলে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে মাসখানেক আগে তিনি পূর্বকোণকে বলেছিলেন, এখন আমরা নেই। বিএনপির লোকজন সব দখল করে নিয়েছেন।
সোনালি যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী পূর্বকোণকে বলেন, আমরা বন্দর থেকে ভাড়া নিয়েছি। বন্দর ও জেলা প্রশাসন বসে ফয়সালা করে নিলে ভালো হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ভয়ে আছি। বিভিন্ন দলের পরিচয়ে নানা শ্রেণির লোক আসে। বিএনপি ঘরানার ব্যবসায়ীরা মৎস্যজীবী দলের সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক নুরুল হক পূর্বকোণকে বলেন, বাজার কমিটি মৎস্যজীবী দলের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। এতে আমরা সম্পৃক্ত নই। তবে বাজারে অবস্থানরত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করে উচ্ছেদের দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে রিট আবেদনকারী হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ পূর্বকোণকে বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের (আওয়ামী লীগ সরকার) নাম ভাঙিয়ে অবৈধ দখল টিকিয়ে রেখেছিল। এখন বিএনপির নাম ভাঙিয়ে তা দখলে রাখতে চায়।
২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর মাছ বাজারসহ চাক্তাই এলাকার ৪৭টি স্থাপনা উচ্ছেদের নোটিশ জারি করেছিলেন জেলা প্রশাসক। পরবর্তীতে তা আর এগোয়নি। গত ২ মার্চ মৎস্যজীবী সমিতির রিট আপিল খারিজ করে দেন আদালত। এর সূত্র ধরে ৭ মার্চ উচ্ছেদ বিষয়ে সদর সার্কেলকে চিঠি দেন জেলা প্রশাসন। চিঠিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের লক্ষ্যে স্থাপনার ধরণ, উচ্ছেদের জন্য জনবল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বুলডোজারের সংখ্যা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করার নির্দেশনা রয়েছে। এরপর উচ্ছেদ আতঙ্কে মানববন্ধন করেন মাছ বাজারের ব্যবসায়ীরা। পুনর্বাসন করে উচ্ছেদের দাবি করেন তারা।
জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর আলাউদ্দিন এ বিষয়ে পূর্বকোণকে বলেন, উচ্ছেদের বিষয়ে আমরা কোনো চিঠি দেইনি।
সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, দুটি মামলা খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এখন নতুন করে আরেকটি রিট করা হয়েছে। আগামী ২৪ এপ্রিল সেই মামলার শুনানি রয়েছে।
২০১৫ সালে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মধ্যবর্তী এক লাখ ৭৩ হাজার ২৬৩ বর্গফুট জায়গা বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডকে ইজারা দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে, ইজারার চুক্তিপত্রের ৫ নাম্বার শর্তে বলা হয়েছে, ‘ইজারাগ্রহীতা জমির ধরণ বা প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন এবং জমির স্থায়ী ক্ষতি করা যাবে না।’ শর্তে আরও বলা হয়েছে, ‘ইজারাকৃত জমি কোন ব্যক্তিকে হস্তান্তর, উপ-ভাড়া দেওয়া যাবে না।’ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে সোনালি যান্ত্রিক মৎস্যশিল্প সমবায় সমিতিকে উপ-ইজারা দেয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি।
দুই পক্ষের চুক্তিতে ৭৪টি দোকান/আড়ত নির্মাণের কথা বলা হলেও বর্তমানে ২০৪টি দোকান রয়েছে বলে জানান সমিতির সভাপতি মো. আলী। এছাড়াও ছোট ছোট অনেক স্থাপনা রয়েছে।
পূর্বকোণ/ইব