চট্টগ্রাম শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫

সর্বশেষ:

সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক

চট্টগ্রামে ‘অস্বাভাবিক’ সিজার

ইমাম হোসাইন রাজু

২৬ মার্চ, ২০২৫ | ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচার) প্রসবের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। অথচ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর ও জেলা চট্টগ্রামে সেই নির্ধারিত সীমা ‘অস্বাভাবিক।’ এই অঞ্চলে বর্তমানে সিজারিয়ান প্রসবের গ্রহণযোগ্য হার সীমার তিনগুণের বেশি।

 

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়- চট্টগ্রামে গত ছয়মাসে যতো প্রসব হয়েছে, তার ৪৮ শতাংশ সিজারিয়ানের মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ অস্ত্রোপচারই হচ্ছে প্রয়োজন ছাড়াই। যার কারণে নবজাতক ও মায়ের দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। এটি বিপজ্জনক প্রবণতা বলেও উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। তাই এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে আরও ভূমিকা রাখার পরামর্শ গাইনি চিকিৎসকদের।

 

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের উদ্যোগে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলার প্রধান সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়ে পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্যমত্রে, স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৬৯টি। এগুলোর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১৬ হাজার ৮৮৫টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১১ হাজার ১৮৪টি। আর সিজার করা হয় ২৬ হাজার ৫১৭টি। সরকারি হাসপাতালে ১০ হাজার ৫১টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১৬ হাজার ৪২৬টি।

 

বাংলাদেশ অবস্টেট্রিক্যাল এন্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির (ওজিএসবি) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি বিশেষজ্ঞ গাইনি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কামরুন নেসা রুনা বলেন, ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রসব সিজারিয়ান করানোর সীমা নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু এ সংখ্যা তিনগুণের বেশি হওয়া অস্বাভাবিক এবং দুশ্চিন্তার বিষয়। এটা বিপজ্জনক প্রবণতা। তাই প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিককে লেবার রুম প্রটোকল (প্রসবঘর নীতিমালা) মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও সেবাকেন্দ্রে এ নীতিমালা মানা হয় না। শহরের বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে তদারকির ব্যবস্থা না থাকাও দায়ী অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের জন্য। সি সেকশন (সিজার) কমিয়ে আনতে কাজ করছে ওজিএসবি। গাইনি চিকিৎসকদের নিয়ে এ বিষয়ে সবসময় সভা সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে ওজিএসবি। আমাদের বিশ্বাস সবার চেষ্টায় এটি দ্রুত কমিয়ে আনতে সক্ষম হব।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মতে, যেকোনো জনগোষ্ঠীতে নানা কারণে কিছুসংখ্যক গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবে মা বা শিশুর বা উভয়ের জীবনের ঝুঁকি থাকে। এই ঝুঁকি এড়াতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচার জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এই জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থার দরকার হয়।

 

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, নরমাল ডেলিভারি বেশি হওয়ার বিষয়টি বেশ ইতিবাচক। তবে ডাক্তার, রোগীসহ সবাই আন্তরিক হলে স্বাভাবিক প্রসবের প্রবণতা আরও বাড়বে। যদিও অস্ত্রোপচারের সংখ্যাও অনেক বেশি। এটি কীভাবে কমানো যায়, সে বিষয়টি নিয়ে সামনে স্বাস্থ্য বিভাগ কাজ করবে। আমরা দেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি রোগীদের আস্থা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের সেবার পরিধি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে।

 

বেসরকারিতেই প্রায় ৬২ শতাংশ অস্ত্রোপচার : চট্টগ্রামের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গত ছয় মাসে সিজারের মাধ্যমে (অস্ত্রোপচার) যত নবজাতকের জন্ম হয়েছে, তার প্রায় ৬২ শতাংশ নবজাতকের জন্ম হয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে। একই সময়ে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া শিশুদের হার মাত্র ৩৮ শতাংশ।

 

তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে ৫৪ হাজার ৫৮৬ জন নবজাতকের জন্ম হয় এ ছয়মাসে। এরমধ্যে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ নবজাতকের জন্ম হয় সিজারের মাধ্যমে। আবার সিজারে জন্ম নেয়া নবজাতকের ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশের জন্ম হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। আর সরকারি হাসপাতালে জন্ম হয় বাকি ৩৭ দশমিক ৯০ শতাংশের।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও প্রাক্তন কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, চমেক হাসপাতালে আসা সিংহভাগ ডেলিভারি রোগীই বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে আসে। বিভিন্ন জেলা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা এসব রোগীদের অর্ধেকের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতো। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু নিয়মনীতি মানা হয়। বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার কেমন হচ্ছে, লেবার প্রটোকল মানা হচ্ছে কিনা, গ্রামগঞ্জের হাসপাতাল ক্লিনিক বা সেবা কেন্দ্রগুলোতে নিয়মনীতি ঠিকমতো মানা হয় কিনা- এসব বিষয় সংশ্লিষ্টদের তদারকি করা প্রয়োজন। তাহলে এটি আরও কমে আসবে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট