চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হল ওরশের বিরিয়ানি বা আখনি। অনেক খাবার সারাদেশে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় কিন্তু এই খাবারটা চট্টগ্রামের বাইরে খুব বেশি একটা পরিচিত না। এই বিরিয়ানি সাধারণত বিভিন্ন মাজারের ওরশে এবং ঈদে মিলাদুন্নবীতে এলাকায় রান্না করা হয়। এর বৈশিষ্ট হল হাড়সহ গরুর মাংস দিয়ে মোটা সিদ্ধ চাল এবং মটরসহ রান্না করা হয়। এছাড়া খুব ঝাল হয়। ভোজনরসিকদের প্রিয় খাবারের তালিকায় উপরের দিকেই থাকে বিরিয়ানির নাম।
খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি তো হরহামেশাই খাওয়া হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের গরুর ঐতিহ্যবাহী ওরশের বিরিয়ানি অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয় কমই। দেখতে খিচুড়ির মত হলেও এটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মোটা চালের বিরিয়ানি। শুধুমাত্র চট্টগ্রামের স্পেশাল মসলা দিয়েই এটি তৈরি হয়। গরুর মাংসের এই বিরিয়ানিতে গরুর মাংসটিও হওয়া চায় স্পেশাল।
ওরশের বিরিয়ানি অন্যসব বিরিয়ানির মত নয়। এর স্বাদ ও ফ্লেভারে রয়েছে একটু ভিন্নতা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পীর-আওলিয়াদের ওরশ, ঈদে মিলাদুন্নবী ও নানান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই বিশেষ রান্নাটি হয়। চট্টগ্রামের কোনও আয়োজন মানেই ওরশের বিরিয়ানি নতুবা মেজবানি গরুর মাংস। আপনি যদি চট্টগ্রামের মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে সপ্তাহে একবার এই বিরিয়ানি খাওয়া আপনার জন্য ডাল-ভাত।
এবার পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার পর নগর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে ওরশ বিরিয়ানি হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা থেকে সাহ্রি পর্যন্ত অস্থায়ী দোকানগুলোতে চলছে মাংস কাটাকাটি, বিরিয়ানি তৈরি ও বেচাবিক্রি। নগরের অলিগলির রেস্তোরাঁ, হোটেলে ঢুঁ মারলেই এই ওরশ বিরিয়ানির ঘ্রাণ নাকে লাগছে। দল বেঁধে বন্ধুরা যাচ্ছেন ওরশ বিরিয়ানির স্বাদ নিতে।
নগরীর জিইসি মোড়ের পাশে লর্ডস ইনের বিপরীতে সানমার টাওয়ার-১ এর পাশে এই রমজানে প্রথমবারের মতো তিন বন্ধু মিলে শুরু করেছে ‘বদ্দার ওরশ বিরিয়ানি’ বিক্রি। এদের মধ্যে সাইফুল হক নামে একজন বলেন, প্রতিদিন জবাই করা হয় একটি আস্ত গরু। যা রান্না করা হয় ১০টি ডেকে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রত্যেকদিন ২-৩শ’ কাস্টমার ফেরত চলে যায়। তবে মান ধরে রাখতে ১০ ডেকের বেশি রান্না করেন না তারা। প্রতি প্লেট বিরিয়ানির দাম মাত্র ১২০ টাকা।
কর্ণফুলীর মইজ্জারটেক মোড়ের পাশে লাগোয়া কয়েকটি ওরশ বিরিয়ানির দোকান আছে। কিন্তু এগুলো ওসমানির কাছে বরাবরই ফেল। এদের ডিঙিয়ে ব্রিজ ঘাটের দিকে যেতেই ডান পাশে চোখে পড়বে ওসমানি ওরশ বিরিয়ানি। শ’খানেক কর্মচারী পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে। ধারণা মতে মাসে ২ কোটি টাকার ওরশ বিরিয়ানি বিক্রির এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।
ওসমানি ওরশ বিরিয়ানির স্বত্বাধিকারী ওসমান গণি বলেন, গত ডিসেম্বরে তিনি ওরশ বিরিয়ানি বিক্রির কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। রোজার শুরু থেকেই ভোজনরসিকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এক থেকে দেড় হাজার মানুষ ওরশ বিরিয়ানির স্বাদ নিচ্ছেন। এ জন্য কোনো দিন দুটি, কোনো দিন তিনটি গরু জবাই দেওয়া হচ্ছে। গতকাল বুধবার তিনটি গরু জবাই করেছেন তিনি।
সিআরবিতে ‘ওরশ হাইলে আইয়ুন’ নাম দিয়ে টাঙানো হয়েছে শামিয়ানা। প্রতিদিন ইফতারের সময় দুই থেকে আড়াই শ রোজাদার সেখানে মিলিত হচ্ছেন। ফুলপ্লেট ১২০, হাফপ্লেট ৭০ টাকায় ওরশ বিরিয়ানির স্বাদ নিচ্ছেন তারা।
বিরিয়ানি তৈরির এই কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ হানিফ বাবুর্চি। তিনি জানান, গত প্রায় দেড় যুগ তিনি বিভিন্ন জায়গায় ওরশ বিরিয়ানি রান্না করছেন। চাল, মাংস, আলু ও মসলার পরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে এ খাবার ভোজনরসিকদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। দরবার থেকে চলে এসেছে হোটেল-রেস্তোরাঁয়।
নগরীর চেরাগীতে বসেছে আবদুল জলিলের ওরশ বিরিয়ানি। জলিল বলেন, আমার আশেপাশে অনেকে ওরশ বিরিয়ানি বিক্রি করছেন। সবার থেকে আমারটার চাহিদা আলাদা। রান্না করেন জলিল বাবুর্চি। যার রান্নার স্বাদও আলাদা। তিনি বলেন, আমি গরু জবাই করি না। প্রতিদিন এক মণ মতো মাংস এনে বিক্রি করে থাকি।
পূর্বকোণ/ইব