সেই অনেকদিন আগের কথা। প্রতিবছর রমজান মাসে গরুর মাংস কেটে বিক্রি করতেন পীরবাড়ির সদস্যরা। ৯০ দশকের মাঝামাঝিতে পীরবাড়ির সদস্য ইলিয়াস, ইদ্রিস, আজিজ ও কুতুব উদ্দিন গরুর মাংস কেটে বিক্রির জন্য দুটি গরু কিনেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় ২০ কেজি মাংস অবিক্রিত রয়ে যায়। মুরব্বিরা পরামর্শ দেন এগুলো দিয়ে মেজবানির মাংস রান্নার জন্য। পরে তাদের পরামর্শে রান্না করে মেজবানির মাংস বিক্রি করা শুরু হয়। এতে বনে যান মেজবানি মাংসের ব্যবসায়ী।
প্রতিবছর রমজান মাস এলেই ধুম পড়ে পীর বাড়ির মেজবানি গরুর মাংস খেতে। পুরো রমজান জুড়ে চলে এই আয়োজন। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে নগরীর চৌমুহনী এলাকার পীরবাড়ির সদস্যদের রান্না করা মেজবানি মাংস আর ছোলার ডালের সুখ্যাতি রয়েছে বেশ। পারিবারিক ‘ঐতিহ্য’ হিসেবে পীরবাড়ির মেজবানির মাংসের এই আয়োজন হয় কেবল রমজান মাসে। এ বছর পীর বাড়ির মেজবানি মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৯৫০ টাকা আর ছোলার ডাল ২৫০ টাকা।
প্রতিদিন ২৫-৩০ কেজি মেজবানি মাংস বিক্রি হয়। তবে শুক্রবার মাংসের চাহিদা একটু বেশি থাকে। গত শুক্রবার প্রায় দেড় মণ মাংস বিক্রি হয়েছিল বলে জানান পীর বাড়ির সদস্যরা। শুরুর দিকে এই মেজবানি মাংস রান্না করেছিলেন বাবুর্চি খালেক। তিনি অসুস্থ থাকায় সেই দায়িত্ব এখন সিরাজ বাবুর্চির হাতে।
গতকাল রবিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পীর বাড়ির সামনে তাঁবু টাঙিয়ে বসানো হয়েছে অস্থায়ী দোকান। টেবিলে রাখা আছে নানা আকারের প্লাস্টিকের বাটি আর বাকরখানি, রুটি। সকাল থেকে শুরু হয় পীরবাড়ির এই মেজবান আয়োজনের কর্মযজ্ঞ। সিরাজ বাবুর্চির রান্নার জাদুতে একপাশে চলে রান্নার আয়োজন আর অন্যপাশে চলে বেচা-বিক্রির ধুম। মূলত বিকেল ৪টার পর থেকে ক্রেতারা পীরবাড়ির মেজবানি মাংস কিনতে ভীড় জমাতে শুরু করেন। ইফতারের পাশাপাশি সেহেরির জন্য বিক্রি হয় মাংস। রাতেও বিক্রি হয় প্রায় ১০ কেজি মাংস। রাতে যারা ঈদের শপিং করতে বের হন তাদের জন্য এসব রাখা হয়। যাতে বাসায় গিয়ে সেহেরির জন্য আর রান্না করা না লাগে। এছাড়াও রমজানে প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার থাকে ১৬০ টাকায় ঐতিহ্যবাহী ওরশ বিরিয়ানি।
স্থানীয়রা জানান, শুধু রমজান মাসেই এলাকাটিতে এভাবে মেজবানি মাংস বিক্রি করা হয়। মাংসের সঙ্গে বিক্রি হয় ছোলার ডালও। ১৯৯৮ সালে মাংস রান্না করেছিলেন বাবুর্চি খালেক। বিক্রেতারা সবাই নিজেকে পীর বংশের সদস্য বলে দাবি করেন।
মাংস কিনতে আসা চাকরিজীবী রাকিব উদ্দিন বলেন, প্রতি রমজানে এখান থেকে মাংস কিনে নিয়ে খাচ্ছি। এখানকার মাংসের ঝোল ও সুঘ্রাণ আমার খুব পছন্দের।
দোকানেই কথা হয় পীর বাড়ি পরিবারের সদস্য কায়সার হামিদ জামসেদের সাথে। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, বংশ পরম্পরায় মেজবানের মাংস বিক্রির আয়োজন চলে আসছে। সারাবছর তো সবাইকে একত্রে পাওয়া যায় না। প্রত্যেক রমজানে এই মেজবানের মাংসের আয়োজন করা হয়। তখন এটা একটা মিলনমেলার মতো হয়ে যায়। খালেক বাবুর্চি অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন রান্না করতে পারেন না। কোথাও ওরশ হলে মাঝে মধ্যে তাকে রান্না করতে দেখা যায়, তবে তা যৎসামান্য।
তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবছর বেচাবিক্রি কম। পণ্যের দাম বেশি থাকায় দামও বাড়াতে হয়েছে। গত বছর ৯০০ টাকা বিক্রি করলেও এ বছর দাম ৫০ টাকা বাড়াতে হয়েছে। তবে ছোলার ডালের দাম আগের মতো আছে। অধিকাংশ সময়ই মাগরিবের আগে বিক্রি শেষ হয়ে যায়। আমাদের দেখাদেখি এখন এই এলাকাতে অনেকগুলো দোকান বসেছে। কিন্তু আমাদের পীরবাড়ির মেজবানের মাংস ঐতিহ্যবাহী বলে সবাই এখানে ছুটে আসে।
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দুবাই, ওমান, সৌদি আরব, লন্ডনেও যায় পীর বাড়ির রান্না করা মেজবানের মাংস। মেজবানের মাংসের চাহিদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ ছাড়াও ঢাকাতে আমাদের মেজবানের মাংসের চাহিদা অনেক। এর বাইরে পশ্চিমা অনেক দেশে আমাদের মেজবানের মাংস যায়।
পূর্বকোণ/ইব