চট্টগ্রাম সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

ইউসুফ চৌধুরীর সমাজসেবার মূল সূত্র

মুনির হাসান

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৭:০৯ অপরাহ্ণ

“If you give a hungry man a fish, you feed him for a day, but if you teach him how to fish, you feed him for a lifetime”. – Lao Tsu

রাউজানের হাজিবাড়ির নছিমা বেগমের তিন ভাইয়ের মধ্যে ইউসুফ চৌধুরী মেজো। আর এ কারণে আমরা তথা নছিমা বেগমের নাতি-নাতনিদের কাছে ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন মেজো দাদা। আমাদের যখন বুদ্ধিসুদ্ধি হয়, স্কুলে উপরের ক্লাসে পড়ি ততোদিনে দাদার নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দাদা একটু রাশভারী ছিলেন বলে আমরা খুব একটা সহজে তাঁর কাছে ঘেঁষতাম না। কেবল দরকার হলে যেতাম। যখন আমি বুয়েটে পড়ি তখন একবার তাঁর কাছে গিয়েছি। সেবার আমরা আন্দরকিল্লায় আমাদের পাড়ায় স্বাধীনতা দিবস পালনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। সেজন্য ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন চাইতে গেলাম। দাদা সব শুনে বললেন, “আরা তো বিজ্ঞাপন ন দিই, বিজ্ঞাপন লই দি” (আমরা দৈনিক পূর্বকোণ) বিজ্ঞাপন দেই না, (অন্যদের) বিজ্ঞাপন নেই (ছাপি)।” আমার একটু মন খারাপই হলো। তারপর চা-নাশতা খেয়ে চলে আসার সময় তিনি আমাকে ডেকে কয়েকজনের কাছে যাওয়ার জন্য বললেন। জানালেন ওনারা বিজ্ঞাপন দেন। ওনাদের কাছে আমি যেন যাই। দরকার হলে উনি বলে দিবেন। সেবার ওনার “কানেকশনে” আমি ম্যাগাজিনের জন্য বিজ্ঞাপন যোগাড়ে সফল হয়েছিলাম। আজ এই খুশির দিনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে মেজো দাদার সঙ্গে নানা স্মৃতির কথা মনে করেছি। তখন টের পেয়েছি দাদা কেন সেদিন আমাকে একটি বিশেষ পথ দেখিয়ে ছিলেন, নিজে আমাকে বিজ্ঞাপন না দিয়ে। কারণ দাদা মানুষকে সেবা করার এটাই ছিল মত ও পথ। চীনা দার্শনিকের মতো তিনিও মনে করতেন- কাউকে একদিনের জন্য সাহায্য করার চেয়ে তাকে জীবনভর চলার পথ বাতলে দেওয়াটাই উত্তম। আর আমাদের মতো দেশে তরুণদের সেবা করার বড় পথ হল তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। নিজে করা ও অন্যদের তাতে উৎসাহিত করা।
যেভাবে শুরু ও বিকাশ : তখন এসএসসি পরীক্ষা ছিল না। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর মোজো দাদা রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসেন। লক্ষ্য মিলিটারি ডিপোতে চাকরি। কিন্তু হলো না। বাড়ি ফিরে গিয়ে ভর্তি হলেন কানুনগোপাড়া কলেজে, আইএ পড়ার জন্য। পড়তে পড়তে ঠিক করলেন চাকরি করে তার পোষাবে না। এর আগে দাদার বয়স যখন ১১-১২, ১৯৩৩ সালে ঝাকড়া চুলের বাবরী দোলানো কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসেছেন রাউজানে যুব সম্মেলন করতে। সেই সময় দাদা তার আর দুইজন তুত ভাইয়ের সঙ্গে মিলে সম্মেলনে একটা চা-এর দোকান দেন। চলে নাই সেভাবে কিন্তু প্রথম অভিজ্ঞতা হয়ে যায়।
কাজে আইএ পাশ করে রাউজানেই নিজের প্রতিষ্ঠান গড়লেন। কী সেটা? ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি, মানে বইয়ের দোকান। আমি বলছি ১৯৪৭-৪৮ সালের কথা। এখনও এই দেশে বইয়ের দোকান চালানো মুশকিল, আর তখন একটা গ্রামে! কাজে চললো না। পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসলেন চট্টগ্রাম শহরে। জুবিলি রোডে তিনহাত জায়গা নিয়ে দিলেন একটা স্টেশনারির দোকান। রেলওয়ে মেন্স স্টোর থেকে জিনিসপত্র কিনে এনে বিক্রি করা। সেখানেই স্টেশনারির পাশাপাশি বিভিন্ন ম্যাগাজিন রাখতে শুরু করলেন, আর পড়া। সে সময় থেকে দেবের একটি ডিকশনারি পার্মানেন্টলি দাদার পকেটে ঢুকে পড়ে। পত্রিকার সঙ্গে শিক্ষার, নতুন জ্ঞানের সম্পর্ক খুঁজে পান তিনি। ভাবলেন নিজেই সরাসরি পত্রিকা আনবেন। মানে পত্রিকার এজেন্ট হবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ডন পত্রিকার এজেন্ট হলেন প্রথমে। একদিন খবর পেলেন ‘আজাদ’ পত্রিকা চট্টগ্রামে একজন এজেন্ট নিয়োগ দেবে। বাড়ি থেকে ১০০০ টাকা জোগাড় করে এনে ছুটলেন কলকাতায়। কিন্তু টাকা থাকা সত্ত্বেও এজেন্সি পেলেন না। চট্টগ্রামে ফিরে এসে দেখলেন পার্টনারের আগ্রহ শেষ। কাজেই এজেন্সিশিপের বেঁচে যাওয়া ৯০০ টাকা দিয়ে পার্টনারের অংশ কিনে নিলেন, তিন হাতি দোকানের পাশে একটা টেইলারিং শপ ছিল। সেটাও কিনলেন। দোকান বড় হলো। বিভিন্ন উৎস থেকে দেশ-বিদেশের ম্যাগাজিন এনে রাখতে শুরু করলেন। জন্ম হল “নিউজ ফ্রন্টের”। করাচির প্যারাডাইজ বুকসের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করলেন। চট্টগ্রাম হয়ে দেশে আসতে শুরু করলো রিডার্স ডাইজেস্টের মত পত্রিকা। নিউজ ফ্রন্টে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়তে শুরু করলেন অনেক। এদের অনেকেই পরে স্বনামে বিখ্যাত হয়েছেন। চট্টগ্রামের ইনটেলেকচুয়াল একটা আড্ডাটাও তৈরি হলো এই দোকানকে ঘিরে।
এর মধ্যে একদিন একটা ট্রেডল মেশিন দিয়ে শুরু করলেন “সিগনেট প্রেস”। সেটি ১৯৫৪ সালের কথা। প্রেসেই বেশি সময় দেওয়া শুরু করলেন, কারণ এই সেক্টরে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু জানলেন লিভার ব্রাদার্সের যে সাবান চট্টগ্রামের কালুরঘাটে তৈরি হয় সেটির মোড়ক আসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে! লাগলেন এর পেছনে এবং শেষ পর্যন্ত লাক্স সাবানসহ মোড়ক বানানোর কাজটা দেশেই রাখলেন। পত্রিকা পড়ার নেশা থেকে পত্রিকা প্রকাশনার কথাও মাথায় আসে। ১৯৮৬ সালে আত্মপ্রকাশ করেন চট্টগ্রামের আধুনিক পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণ। অনেকেরই জানা নেই সংবাদ পত্রের আধুনিক ফটো টাইপসেটিং- এর এদেশীয় যাত্রা শুরু হয় দৈনিক পূর্বকোণে। তার আগেই প্রতিষ্ঠা করেছেন সিগনেট বক্স।
৯০ এর দশকে নিজের সত্তরোর্ধ্ব বয়সে আবিষ্কার করেন পাহাড়, সমুদ্রবেষ্ঠিত চট্টগ্রামের লোকেদের পুষ্টি নিয়ে ভাবার লোক নাই। শুরু করলেন ডেইরি ও পোল্ট্রি আন্দোলন। কিন্তু অচিরেই দেখলেন এই সেক্টরে জ্ঞানী-গুণী লোক নাই। শুরু হলো- চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এবং আদায় করেই ছাড়লেন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
কঠিন পথে সমাজসেবা ইউসুফ চৌধুরীর উদ্যোক্তা হয়ে ওটার পেছনে অনেকগুলো প্রণোদনার বড় একটি ছিল মানুষের সেবা করার সুযোগ। মেজো দাদার কাছে যখন কেউ নিজের বা সন্তানদের জন্য সাহায্যের কথা বলতেন তখন তিনি সহজ চিন্তা করতেন লাও যু’র মতো। সেটা হলো- ওদেরকে একদিনের জন্য সাহায্য করে তেমন লাভ হবে না। বরং তাদের সাহায্য করা দরকার জীবনব্যাপী। আর সেজন্য তিনি শ্রমঘন সব উদ্যোগের কথা ভাবতেন। সেটা প্রেস হোক, বক্স হোক, ডেইরি হোক বা হোক দৈনিক পত্রিকা। শুধু নিজে একা একা কর্মসংস্থানের সমীকরণের সমাধান করে ফেলবেন এমনটাও কিন্তু ভাবতেন না। কারণ তিনি জানতেন একটা ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।
ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরা যাক। নিজের সুপার ডেইরির লাল গাভীর অসুস্থতা থেকে শুরু করে ‘শাদা’ বিপ্লবের অনুসারী সেই সময়ের চট্টগ্রামের ডেইরি খামারগুলোর পশুদের চিকিৎসার সংকটের কথা ধরা যাক। সে সময় কেউ কেউ তাঁকে পশু হাসপাতাল করার পরামর্শ যে দেয় নাই তা কিন্তু নয়। কিন্তু তিনি সমস্যার আরও গভীরে গিয়ে দেখেছেন, সংকটের শুরু যথাযথ প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাবে। আর সেটা পূরণ হতে পারে যদি একটা ভালো মানের ভেটেরিনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া যায়। চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারলে সে অভাব দূর হতে পারে। সেজন্য দলে-বলে নেমে পড়লেন ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নে। পরেরটুকু আমরা জানি।
মেজো দাদার ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ায় জোর দেওয়াটা আমাদের দেশের প্রচলিত ধারণার চেয়ে ভিন্নতর। অন্য অনেকের চেয়ে এখানেই তার আলাদা বৈশিষ্ট্য সমস্যার গভীরে গিয়ে সেটি সমাধানের চেষ্টা করা। এই বৈশিষ্ট্য যদি নতুনদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো আরও বেগবান হবে। চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরীর একুশে পদক প্রাপ্তিতে মহা-আনন্দিত তার নাতি-নাতনি এবং আমাদের পরেরও পরের জেনারেশনের পক্ষ থেকে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া জানাই।

 

দৈনিক প্রথম আলো’র ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক।

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট