জমি পাওয়া নিয়ে জটিলতা। জমি পেলেও সেই জমি অন্য প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেয়া। শেষ পর্যন্ত জমি না পাওয়ায় প্রকল্প ফেরত চলে যাওয়া। অনেক দৌড়ঝাঁপের পর প্রকল্প ফিরিয়ে আনা। শেষ পর্যন্ত গোঁয়াছি বাগানের নির্মিতব্য জায়গাটি পছন্দ।
কিন্তু অবৈধ বসতি সরাতে গিয়ে বেগ পেতে হয়। বসতি সরালেও নতুন বাধা হয় পাহাড়। সেই পাহাড় নিয়েও পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। শেষ পর্যন্ত পাহাড় রক্ষা করে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও এবার দেখা দিলো আরেক বাধা।
এমনিতেই জায়গা জটিলতাসহ নানা কারণে দীর্ঘ এক দশক ঝুলে ছিল চট্টগ্রামের বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট প্রকল্প। যদিও দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর গেলো বছর বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখে চীনের অর্থায়নে নির্মিতব্য বিশেষায়িত হাসপাতালটি। এরপর অর্থবরাদ্দ থেকে শুরু করে প্রকল্পের অনুমোদন এবং ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কাজও এগোতে থাকে। ইতোমধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজও শুরু করেছেন চীনের প্রকৌশলীরা। তবে নতুন করে ফের দেখা দিলো ‘বাধা’।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি এভাবে জটিলতায় পড়তে থাকলে চীনের অর্থ ফেরত যাবে। এতে প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখবে না। তাতে পুরো চট্টগ্রামবাসী তাদের কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই সকল বাধা অতিক্রম করে দ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দাবি তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে বিশেষায়িত বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট নির্মাণে আগ্রহ দেখায় চীন। সেসময় চীনের একটি প্রতিনিধি দল স্থান নির্বাচনের জন্য চট্টগ্রামে এসেছিল। এরপর চমেক হাসপাতালের বর্তমান বার্ন ইউনিটের পেছনের খালি জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বন্দোবস্ত হয়। হাসপাতাল প্রশাসনও তাতে সায় দেয়। এর প্রেক্ষিতে চীনা দলটি দেশে গিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা অবহিত করে। চীন সরকারও তাতে সম্মতি জানায়। সবুজ সংকেত পাওয়ার পর চিহ্নিত এ জায়গা ঘিরে বিশেষায়িত বার্ন ইউনিটের অবকাঠামো নির্মাণের ডিজাইনও শেষ করে চীনা দলটি। কিন্তু ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ২য় দফায় পরিদর্শনে এসে জানতে পারে ওই জায়গাটি এর আগে থেকেই একটি আধুনিক রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং সেন্টার স্থাপনের জন্য চিহ্নিত করা। সেটি নির্মাণ করা হবে জাপানি দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে। এরপর একটি উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন না হওয়ায় ফেরত যায় চীন।
একপ্রকার অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় এ প্রকল্প বাস্তবায়নে। কয়েক দফার রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ২০২০ সালের ২০ জুলাই এক বৈঠকে চীন সরকারের পক্ষ থেকে ফের চট্টগ্রামে ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ বার্ন হাসপাতাল’ নির্মাণে সাড়া দেয়। ফলে আশার আলোর দেখা মেলে। এরপর প্রকল্পটি ধীরে ধীরে বাস্তবায়নে রূপ নেয়। বহুবার চীনা প্রতিনিধি ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের দলের আলোচনা শেষে সর্বশেষ চমেকের প্রধান ছাত্রাবাস সংলগ্ন হাসপাতালের আওতাধীন গোঁয়াছি বাগান এলাকাতেই এ বিশেষায়িত ইউনিট নির্মাণ করার জন্য চূড়ান্ত হয়। কিন্তু এলাকাটিতে অবৈধ বসতি থাকায় ওই সময়ে বাধার মুখে পড়তে হয়। তবে ২০২৩ সালের এপ্রিলে সেই বসতি উচ্ছেদ শুরু হয়। তবে জায়গা খালি হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন, অর্থ পাওয়াসহ নানা কারণে ধীরগতি দেখা দেয়। বিদায়ী অর্থবছরে কাজ শুরু হলেও সর্বশেষ পাহাড় নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীন বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করতে গেলে একজন পোড়া রোগী পথেই মারা যান। অথচ বিশেষায়িত এ বার্ন ইউনিটে সবধরনের সুযোগ সুবিধা থাকবে। স্থাপনাটি হয়ে গেলে সেখানে একসঙ্গে ১৫০ জন পোড়া রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন। এটি হবে দেশের দ্বিতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট।
তিনি আরও বলেন, এমনিতেই নানা কারণে বহুবার কাজ পিছিয়েছে। এখন যদি এভাবে নানা প্রশ্নের মধ্যে পড়তে হয়, কাজ যদি বন্ধ হয়, তাহলে চীনা প্রকৌশলীরা কাজ না করে চলে যাবে। তাদের অর্থও ফেরত দিতে হবে। কাজ আর হবে না। আমরা বরাবর বলেছি, পাহাড়ের মধ্যে কোন হাসপাতাল হচ্ছে না। বরং পাহাড়কে রক্ষা করার জন্যই পাহাড়ে ড্রেসিং করা হচ্ছে। ভৌত অবকাঠামোগত কাজ করার আগে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়কে ঢালু আকারে কেটে চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে কলাম বসানো হবে। পাহাড়ের আকৃতির পরিবর্তন হবে না। উচ্চতাও ঠিক থাকবে। দ্রুত কাজটি বাস্তবায়ন করতে চট্টগ্রামবাসী সহযোগিতা করা দরকার।
চীনা প্রতিনিধি দলের প্রধান মে ইইউ চ্যং বলেন, পাহাড়টা দেখার পর আমাদের মনে হয়েছে ভবন হলে জায়গাটি নিরাপদ হবে না। কারণ ভবনে বেইজ করার সময় পাহাড় ধসে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। পাহাড়টির মাটি খুবই নরম। পানির স্পর্শ পেলে সেটি নিচের দিকে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকৌশলীরা সয়েল নেইলিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পাহাড়টি ড্রেসিং করে কলাম বসিয়ে কাজ করবে। পরে সেখানে ঘাস লাগানো হবে।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, চট্টগ্রামে বহু শিল্প কারখানা রয়েছে। বেশিরভাগ সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু অগ্নিকা-ের পর দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে বেগ পেতে হয়। ঢাকায় নেয়ার পথে অনেকে মারা যান। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ বার্ন হাসপাতাল নির্মাণ জরুরি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সমালোচনার মুখে নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। এমন হলে চট্টগ্রামবাসীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। ছোট ছোট অজুহাত তুলে এভাবে যদি কাজ বন্ধ থাকে, তাহলে একসময় চীন তাদের অনুদান ফেরত নিয়ে যাবে। এতে বঞ্চিত হবে চট্টগ্রামবাসী। তাই অবিলম্বে এই বার্ন হাসপাতালের নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নেটওয়ার্ক মেম্বার (চট্টগ্রাম) আলিউর রহমান বলেন, পাহাড় কাটার খবর পেয়ে প্রথমে আমরাও গিয়েছিলাম। আমি নিজেই পর্যবেক্ষণ করেছি, মাটি সরানো হয় কিনা। তবে সেটি পাওয়া যায়নি। পাহাড় রক্ষার জন্য তারা কাজ করছে। পাহাড়ের আকার পরিবর্তন হচ্ছে না। তাহলে এটিকে পাহাড় কাটা বলতে পারি না। এর জন্য সাধুবাদ জানাতেই হয়। কর্তৃপক্ষ পাহাড় রক্ষা করতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটি যেন ঠিক থাকে। পাহাড় না কেটে বার্ন ইউনিট করা হোক। এটি চট্টগ্রামবাসীর দাবি।
উল্লেখ্য, নির্মিতব্য বার্ন ইউনিট প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮৪ কোটি ৭৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র বাবদ মোট ১৭৯ কোটি ৮৩ লাখ ২০ হাজার টাকা চীন সরকার বহন করবে। বাংলাদেশ সরকার ৭০ কোটি টাকা কাস্টমস ডিউটিসহ আনুষঙ্গিক রাস্তা, সীমানা প্রাচীর, বৈদ্যুতিক সংযোগ, নিরাপত্তা ইত্যাদি বাবদ মোট ১০৪ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার বহন করবে।
চমেকের প্রধান ছাত্রাবাস সংলগ্ন হাসপাতালের আওতাধীন গোঁয়াছি বাগান এলাকাতেই এ বার্ন ইউনিট নির্মাণ করা হবে। জায়গায়টিতে ইতোমধ্যে হাসপাতাল নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
পূর্বকোণ/পিআর