চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথারঘাটা এলাকার জনি দে। ভোটার হতে গিয়ে তার মাথায় ভাঁজ পড়েছে। মায়ের নাম বাংলা ও বাবার নামে ইংরেজি অক্ষরে ভুল রয়েছে। নিজে ভোটার হওয়ার চেয়ে এখন মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনে গলদঘর্ম অবস্থা। ভোটার হতে গিয়ে একইভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন আরও তিনজন। ১০-১৫ দিন ধরে নির্বাচন অফিসে ঘুরছেন বলে জানান তারা।
চকবাজার ওয়ার্ডের উর্দু গলি এলাকার ব্যবসায়ী আনোয়ারুল হক ছেলের পাসপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে পড়েছেন ঝামেলায়। তিন মাস ধরে ঘুরছেন স্ত্রীর এনআইডি সংশোধন করতে। এখনও সংশোধন করতে না পারায় ছেলের পাসপোর্ট বানাতে পারছেন না তিনি। শুধু জনি দে বা আনোয়ারুল হক নন, ভোটার হতে গিয়ে দুর্ভোগ-ভোগান্তির কথা বললেন ১০-১২ জন। সম্প্রতি নগরীর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে।
জনি দে বললেন, স্কুল সনদে মায়ের নামের সঙ্গে এনআইডিতে ইংরেজি ‘ও’ আর ‘ঊ’ অক্ষরে অমিল রয়েছে। আবার বাবার এনআইডিতেও বাংলা অক্ষরে ভুল রয়েছে। এখন নিজে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে গিয়ে দুর্দশায় পড়েছি। মা-বাবার এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে নিজেই বেকায়দায় পড়েছি।
চকবাজার এলাকার আনোয়ারুল আজিম বলেন, ছেলের স্কুল সনদে মো. আনোয়ারুল আজিম লেখা রয়েছে। কিন্তু আমার এনআইডিতে ‘মো.’ নেই। আর আমার স্ত্রীর নামে ‘বেগমের’ স্থলে ‘খাতুন’ হয়ে গেছে। এছাড়া ইংরেজি অক্ষরেও অমিল রয়েছে। ছেলে পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে তা নজরে পড়ে। ছোট সেই ভুলের সংশোধন করতে গিয়ে তিন মাস ধরে গলদঘর্ম অবস্থা।
নগরের লাভ লেন এলাকায় অবস্থিত জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে কথা হয় ১০-১২ জনের সঙ্গে। কেউ মা-বাবার এনআইডি ভুলের জন্য, কারও স্কুল-কলেজের সনদে নিজে ও মা-বাবার নামে অমিল, কেউ জায়গা-জমির খতিয়ান না থাকা, কেউ বা সেবা সংস্থার কাগজপত্র দিতে না পারার কারণে ভোটার হতে দুর্ভোগ-ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অনেকেই ২-৪ মাস ধরে ঘুরছেন নির্বাচন অফিসে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, চার মাস আগে মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করেছিলাম। কর্মকর্তারা এই-ওই ডকুমেন্ট তলব করেন। অনেক হয়রানি-ভোগান্তির পরও সংশোধন করতে পারিনি। শেষে এক দালালের শরণাপন্ন হই। পাঁচ হাজার টাকায় বনিবনা হয় তার সঙ্গে। দফায় দফায় তিন হাজার টাকা দেই। এখনও সংশোধন করতে পারিনি।
দুর্দশায় প্রবাসীরা : সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রবাসীরা। পাসপোর্ট নবায়নের সময় প্রতিনিয়ত দুর্দশায় পড়তে হয়। পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা ও কাতার প্রবাসী আবুল মনসুর মোবাইলফোনে বলেন, পাসপোর্ট ও এনআইডিতে নামে অমিল রয়েছে। অমিলের কারণে বাংলাদেশে পাসপোর্ট নবায়ন করতে পারেননি। এছাড়াও পুলিশ ভেরিফিকেশন ঝামেলাও রয়েছে। শেষমেশ কাতারে গিয়ে নবায়ন করেছেন। কীভাবে করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাসপোর্টের সঙ্গে মিল রেখে অনলাইন জন্মনিবন্ধন করেছি। সেই জন্মনিবন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট নবায়ন করেছি।
বোয়ালখালীর মো. সাহেদ আকবর নামে এক প্রবাসী বলেন, এনআইডি ও পাসপোর্টে সাহেদ নামে ইংরেজি বানানে অক্ষরে ভুল ছিল। ছোট ভুলের কারণে পাসপোর্ট নবায়ন করতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। শেষে উপজেলা নির্বাচন অফিসে অনেক দেন-দরবার ও বকশিশের বিনিময়ে এক অক্ষরের ভুল সংশোধন করেছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভুল সংশোধন ও ভোটার হতে আগ্রহীদের ভোগান্তিকে ঘিরে একটি দালালচক্র গড়ে উঠেছে। আউটসোর্সিং কর্মচারী, চাকরিচ্যুত কর্মচারী ও পুরনো দালাল মিলে এই চক্র কাজ করছে। তবে প্রকাশ্যে নয়, কৌশলে কাজ করেন তারা।
সূত্র জানায়, ভুল সংশোধনের কম্পিউটার দোকান থেকে আবেদন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে কম্পিউটার দোকানদারও দ্রুত কাজ করে দেওয়ার নামে দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আন্দরকিল্লা এলাকার কয়েকজন কম্পিউটার দোকানি এই কাজে জড়িত বলে জানা যায়।
রোহিঙ্গা সংকট : রোহিঙ্গা নাগরিকদের কারণে বড় ভোগান্তিতে পড়েছেন চট্টগ্রামের নাগরিকেরা। চট্টগ্রাম জেলাকে ‘বিশেষ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটার হতে সাধারণত জন্মসনদ, জাতীয়তা/নাগরিকত্ব সনদ, নিকটাত্মীয়ের এনআইডি, এসএসসি/সমমান অথবা অষ্টম শ্রেণি পাসের সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ও বিদ্যুৎ/গ্যাস/পানি/চৌকিদারি ট্যাক্স রশিদের ফটোকপিসহ পাঁচ ধরনের কাগজপত্র জমা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসি। কিন্তু বিশেষ এলাকা হিসেবে ১৮ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হবে। এ নিয়ে জেলার বাসিন্দারা ভোটার হতে গিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী পূর্বকোণকে বলেন, ভোটার হতে ইচ্ছুকদের পূর্বের মতো দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। তিন ক্যাটাগরির ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
পূর্বকোণ/পিআর