১৪ বছর আগে ১০ লাখ টাকা নিয়ে মোজাম্বিকে পাড়ি জমান নোয়াখালীর বাসিন্দা মোহাম্মদ ইয়াছিন। সেই টাকায় ব্যবসা করে একযুগ পরিশ্রমের পর তিনি এখন কোটিপতি। দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে মোজাম্বিকে তিনি গড়ে তোলেন ভুট্টা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ও সুপার সপ। সব মিলিয়ে পুঁজি ছিল ১২ কোটি টাকা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে একরাতেই ইয়াছিন কোটিপতি থেকে হয়ে পড়েন নিঃস্ব। নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক অরাজকতার বলি হলেন কবিরহাটের ইয়াছিন। সব হারিয়ে ঋণগ্রস্ত। ইয়াছিন পরিবার নিয়ে হয়ে পড়েছেন দিশেহারা।
মোজাম্বিকের মিথিয়া শহরে বসবাস করা মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, আমার কারখানায় ১২শ টন (১২ হাজার বস্তা) ভুট্টা ছিল। সব লুট করে নিয়ে গেছে। আমার কারখানায় কাজ করে ৪০ জন বাংলাদেশি। তাদের মারধর করায় তারা প্রাণ ভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে আছেন। আমার ভাইয়ের দুটি দোকানসহ আমার আরও একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুট করেছে। সেখানে একটি পেরেকও রাখেনি। এতে আমার ১২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবেদন দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন।
শুধু মোহাম্মদ ইয়াছিন নয়, একরাতেই এভাবে নিঃস্ব হয়েছেন হাজারও ব্যবসায়ী। যাদের ৭৫ শতাংশই চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে মোজাম্বিকে যাওয়া ব্যবসায়ী।
মোজাম্বিকে বাংলাদেশ কমিউনিটির আহ্বায়ক আনিছুর রহমান। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শিলকূপে। তিনি জানান, মোজাম্বিকে ৮ হাজার বাংলাদেশি ব্যবসা করেন। এরমধ্যে ৬ হাজার ব্যবসায়ীর বাড়িই চট্টগ্রামে। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকান দেশ মোজাম্বিকে বাংলাদেশিদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ ও নজিরবিহীন লুটপাট চলছে। দুই রাতে হাজারও বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ দুর্বৃত্তরা। এতে শত শত প্রবাসী ব্যবসায়ী তাদের জীবনের সমস্ত সঞ্চয় হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এখন তারা শুধু বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছেন।
মোজাম্বিক বাংলাদেশ কমিউনিটির লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মোজাম্বিকের সাংবিধানিক আদালত সোমবার বিতর্কিত নির্বাচনে ফ্রেলিমো পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ড্যানিয়েল চ্যাপোর বিজয় নিশ্চিত করেছে। তবে বিরোধীদলের নেতা ভেনানসিও মন্ডলানে নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে অভ্যুত্থানের হুমকি দিয়েছেন। এরপর থেকেই বাংলাদেশিদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নজিরবিহীন লুটপাট শুরু হয়েছে। লুটপাটকারীদের সহযোগিতা করছে সেনাবাহিনীও। সন্ধ্যা নামলেই লুটপাট চলছে মাপুতো, সিমুই, বেইরা, নামপুলা, মুনফোলা, নাখালা, জাম্বিজিয়া, ইলিমান, বেয়ারাও মকুবাসহ বহু শহরে। মোজাম্বিকে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের।
মোজাম্বিকের বেরা শহরে থাকেন কক্সবাজারের আলমগীর। কান্না করতে করতে তিনি বললেন, আমার দোকানে ৩০ লাখ টাকার মালামাল ছিল, কালোরা (কৃষ্ণাঙ্গ) রাতে সব নিয়ে গেছে। ৩০ লাখ টাকার মালের মধ্যে ৩০ পয়সার মালও নেই। আমি নিঃশ্ব হয়ে গেছি, শেষ হয়ে গেছি।
মোজাম্বিকের মুকুবা শহরে থাকেন বাঁশখালীর ছানুয়ার মকছুদ আহমদ। তিনি বলেন, রাত হলেই এখানে প্রচুর পরিমাণ লুটপাট চলছে। সোমবার আমার ভাতিজার দোকান থেকে ৩০ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে কৃষ্ণঙ্গরা। আমরা খুবই আতঙ্কে আছি। এখানে প্রতিটি দোকানে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯০ লাখ-দেড় কোটি টাকার মালামাল থাকে।
১৬ বছর ধরে দক্ষিণ মোজাম্বিকে থাকেন ফেনী সদরের মোহাম্মদ রবিউল হক বেলাল। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর থেকে এখানের অবস্থা খুবই খারাপ। বাংলাদেশিদের প্রায় ৮০% ব্যবসায়ী লুটপাটের শিকার। শুধু বাঙালি নয়, লোকাল ব্যবসায়ীদেরও তারা ছাড় দিচ্ছে না।
বাংলাদেশ কমিউনিটি মোজাম্বিকের আহ্বায়ক আনিছুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, সোমবার বিকাল থেকে রাজধানী মাপুতো থেকে লুটপাট শুরু হয়। জঙ্গল থেকে ২০-৩০ হাজার কালো (কৃষ্ণাঙ্গ) এসে একসাথে এ্যাটাক করছে। তখন পুলিশ আর কিছু করতে পারে না। তবে সেনাবাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করছে। উল্টো লুটপাটকারীদের সহযোগিতা করছে। সেনাবাহিনী হয়ত বিরোধীদলকে সাপোর্ট করছে। মোয়ানি নামে একটি জায়গায় বাংলাদেশিদের ১৬টি দোকান আছে। এসব দোকানের কিছুই রাখেনি। টিন পর্যন্ত খোলে নিয়ে গেছে। খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতি। পর্তুগাল বাংলাদেশ হাই কমিশন আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। তারা বলেছে- বাংলাদেশিদের একটি তালিকা করতে। আমরা সেটিও করার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশ দূতাবাস, লিসবন, পর্তুগালের কাউন্সিলর ও চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স লায়লা মুনতাজেরী দীনা পূর্বকোণকে বলেন, নির্বাচনের পর থেকে আমরা মোজাম্বিকের কমিউনিটির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। ওখানে একজন অনারারি কনসালটেন্টও আছেন। তিনিও বিষয়গুলো আমাদের অবহিত করেন। দু’দিন আগেও কমিউনিটির উদ্দেশে একটি ভয়েস ম্যাসেজ দিয়েছি। সবসময় বাংলাদেশিদের খোঁজখবর নিচ্ছি। বাংলাদেশিদের সমস্যা নিয়ে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগও রাখছি। যেভাবে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা আসবে সেভাবে কাজ করব। এখন সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ দূতাবাস পর্তুগাল সবসময় বাংলাদেশিদের পাশে আছে। যেহেতু পর্তুগাল মিশন থেকে মোজাম্বিকের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
পূর্বকোণ/ইব