চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

জনপ্রিয়তাই কি কাল হলো ‘চট্টলা চাকা’র

আরাফাত বিন হাসান

৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১২:৩১ অপরাহ্ণ

অনেকটা ঘটা করেই ২০২২ সালের ২৩ মে চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন-ফটিকছড়ি রুটে যাত্রা শুরু করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস ‘চট্টলা চাকা’। এরপরই তুলনামূলক উন্নত ও যাত্রীবান্ধব সেবার কারণে জনপ্রিয়তা পায় বাস সার্ভিসটি। তবে সেই জনপ্রিয়তাই কাল হল ‘চট্টলা চাকা’র।

 

বাস মালিকদের একটি সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে ৬ ডিসেম্বর যাত্রীবান্ধব এই সার্ভিসটি বন্ধ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ফটিকছড়ি অঞ্চলের যাত্রীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই বাস সার্ভিসটি বন্ধ করায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন যাত্রীরা। এরমধ্যে শনিবার ফটিকছড়ি-অক্সিজেন রুটে ‘চট্টলা চাকা’ বাস সার্ভিস পুনরায় চালু ও সার্ভিসটি বন্ধের পেছনে জড়িত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছেন ১০০ জন যাত্রী। বাস সার্ভিসটি বন্ধ করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব হয়েছেন যাত্রীরা।

 

যাত্রীদের অভিযোগ, মূলত ওই সড়কে চলাচল করা অন্যান্য বাস সার্ভিসের নিম্নমানের সেবা ও হরহামেশা যাত্রী হয়রানির মধ্যে উন্নত ও যাত্রীবান্ধব সেবা পেয়ে ‘চট্টলা চাকা’ বাস সার্ভিসের দিকে ঝুঁকে পড়েন যাত্রীরা। এতে তুলনামূলক কম যাত্রীর কারণে কিছুটা লোকসানে পড়ে ওই রুটের অন্যান্য বাস সার্ভিস। সেসব বাস মালিকদের একটি সিন্ডিকেট যাত্রী সেবার মান না বাড়িয়ে উন্নত সেবার ‘চট্টলা চাকা’ বাস সার্ভিসটি বন্ধে তৎপর হয়ে উঠে। গেল দুই বছর অক্সিজেন-ফটিকছড়ি রুটে ‘চট্টলা চাকা’ ঠিকঠাক চলাচল করলেও ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে যাত্রীবান্ধব ওই বাস সার্ভিস বন্ধে উঠেপড়ে লাগে সিন্ডিকেটটি। ‘চট্টলা চাকা’ কর্তৃপক্ষকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ আখ্যা দিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকে এক মাসের বেশি সময় ধরে এই বাস সার্ভিসটি বন্ধ রাখতে বাধ্য করে তারা। পরবর্তীতে নাজিরহাট বাস মালিক সমিতি ও ফটিকছড়ি উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ১০ সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় চলাচল শুরু করে ‘চট্টলা চাকা’।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেল ১৭ নভেম্বর ‘চট্টলা চাকা’ বাস সার্ভিসটি বন্ধ করতে নাজিরহাট বাস মালিক সমিতির কাছে একটি চিঠি লিখেন ওই সিন্ডিকেটের কয়েকজন। আটজন বাস মালিকের স্বাক্ষর করা ওই চিঠিতে ‘চট্টলা চাকা’র কারণে বাস মালিকদের ‘বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হবে’ বলে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে বাস সার্ভিসটি বন্ধ রাখতে ‘চট্টলা চাকা’ কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে ওই সিন্ডিকেট। এর প্রেক্ষিতে নানামুখী চাপে বাধ্য হয়ে ওই বাস সার্ভিসটি বন্ধ করে দেয় ‘চট্টলা চাকা’ কর্তৃপক্ষ।

 

এই রুটে ‘চট্টলা চাকা’ বাস সার্ভিসের নিয়মিত যাত্রী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অক্সিজেন ফটিকছড়ি রুটের বাসগুলো যাত্রীদের জিম্মি করে রেখেছিল দীর্ঘদিন। হরহামেশা যাত্রী হয়রানি, ইচ্ছেমত ভাড়া আদায়, যত্রতত্র যাত্রী উঠানো-নামানো, অকারণে মাঝপথে দাঁড়িয়ে থাকাসহ নানা কারণে তাদের ওপর সাধারণ যাত্রীরা খুবই বিরক্ত ছিল। চট্টলা চাকা যাত্রা করার পর ওটা ভালো সার্ভিস দিত, এখন এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগের মতো ভোগান্তিতে পড়তে হবে।

 

এই বিষয়ে ‘চট্টলা চাকা’র নির্বাহী পরিচালক মো. শাহজাহান বলেন, ওদের হুমকি-ধমকির কারণে বাস বন্ধ করতে হয়েছে। চট্টলা চাকা বাস বন্ধ না করলে মালিক সমিতির কার্যালয়ে তালা দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। তাছাড়া ৫ আগস্টের পর গাড়িতে হামলা করেছে একাধিকবার, কয়েকজন চালককেও মারধর করেছে। এরমধ্যে একটি কাউন্টারে আগুনও লাগিয়ে দিয়েছিল। তারা ৭০ টাকা ভাড়া নেয়, আমরা ১০০ টাকা নিই। কিন্তু তাদের দাবি আমাদের ১৬০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু আমরা কেন এত বেশি ভাড়া নির্ধারণ করে যাত্রীদের পকেট কাটতে যাব?

 

নাজিরহাট বাস মালিক সমিতির কাছে লেখা চিঠিতে যে আট জন বাস মালিকের স্বাক্ষর রয়েছে তাদের দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাদের একজন মো. রিদোয়ান বলেন, এক রুটে একাধিক সার্ভিস চলাচল করতে পারে না। তাছাড়া ওটা যেহেতু এসি বাস সার্ভিস, তাই আমরা বলেছি যেন ভাড়া ১৬০ টাকা করে নেয়। কিন্তু ওরা ভাড়া নির্ধারণ করেছে ১০০ টাকা, এতে আমাদের সাধারণ মালিকদের সমস্যা হচ্ছে। অন্যজন মো. আমান উল্লাহ বলেন, ওরা লোকাল গাড়ির পারমিট নিয়ে এসি বাস চালাচ্ছে। কিন্তু এটা আলাদা পারমিটে চলতে পারবে, পারমিটটা আমাদের দেখাতে হবে। তাদের কারণে আমরা সাধারণ বাস মালিকদের ক্ষতি হচ্ছে। আর আমি বন্ধ করার কেউ না, আমি তাদের বাস বন্ধ করিনি। আমরা মালিক সমিতিকে জানিয়েছি শুধু।

 

এই বিষয়ে নাজিরহাট বাস মালিক সমিতির সভাপতি ইদ্রীস মিয়া বলেন, এসি বাস চলাচলের কারণে নাকি লোকাল বাসের মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের যাত্রী কমে গেছে। ‘চট্টলা চাকা’ নিয়ে যাত্রীরা সন্তুষ্ট ছিল। কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারলে, ভালো সেবা পেলে সবাই পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এই কারণে ‘চট্টলা চাকা’তে যাত্রী বেশি হয়। এখন কয়েকজন মালিক এই বাস সার্ভিসটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। তবে বাসগুলো যেহেতু বিলাসবহুল, তাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি যেন না হয় সেজন্য আপাতত বন্ধ রাখছে কর্তৃপক্ষ।

 

যাত্রীবান্ধব সেবাগুলো রক্ষায় সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যারা সর্বোত্তম সেবা দেয়, যেসব সার্ভিসকে যাত্রীবান্ধব পরিবহন বলে মনে করেন যাত্রীরা, তাদের টিকিয়ে রাখা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব। কিন্ত বিআরটিএ বা ট্রাফিকে যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় এটা হয়ে উঠে না। এই কারণে যাত্রীবান্ধব উদ্যোগগুলো নানামুখী চাপে মুখ থুবড়ে পড়ছে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট