চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সাবেক কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন হাজারী। যিনি কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তার আগেই গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। গেলো ১১ সেপ্টেম্বর এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৭৯ লাখ ৩৬ হাজার ৬২২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে মামলা করে দুদক।
শুধু আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধেই নয়, গত এক বছরে চট্টগ্রামের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিভিন্ন অপরাধে ৩১টি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে ২১টি মামলা দায়ের করা হয় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের ঘটনায়। যার মধ্যে ১৪টি মামলা হয় আমজাদ হোসেনের মতো সরকারি চাকরিজীবী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে। এসব মামলার ৪৩ দশমিক ৩৩ শতাংশই সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে। যারা সরকারি চাকরিতে থেকে অবৈধ উপায়ে অর্জন করা অর্থ দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
চট্টগ্রামে গত এক বছরে দুদকের দায়ের হওয়া মামলার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া যায়। দুদক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয় ১ ও ২ এর গত এক বছরের মামলার তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে সর্বমোট ৩১টি মামলা করে সংস্থাটি। এসব মামলার ২১টিই হচ্ছে অবৈধভাবে জ্ঞাতআয় বর্হির্ভূত সম্পদ অর্জনের। যা শতকরায় ৬৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাকি মামলার মধ্যে ৬টি হচ্ছে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ; যা শতকরায় ১৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এছাড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতে ৩টি মামলাও করে সংস্থাটি। যা মোট মামলার ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বাকি ১টি মামলা ছিল জাল-জালিয়াতি বা সরকারি ক্ষতিসাধনের। যা শতকরায় ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। আলোচ্য ৩১টি মামলায় আসামি করা হয় মোট ৬৭ জনকে। যাদের মধ্যে ২৬ জন আসামিই হচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবী। যা শতকরায় ৩৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। তবে এসব সরকারি চাকরিজীবীর স্ত্রীসহ হিসেব করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪ জনে। যা মোট আসামির ৫০ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
বাকিদের মধ্যে ১০ জন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা রয়েছেন। যা শতকরায় ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। এছাড়া ব্যবসায়ী আছেন ১৪ জন বা ২০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ আছেন জনপ্রতিনিধি। যার সংখ্যা মাত্র দু’জন। রাজনৈতিক দলের একজন নেতা রয়েছেন এ তালিকায়। এর বাইরে সরকারি চাকরিজীবী ও অন্যান্য আসামির স্ত্রী আছেন ১১ জন। অন্যান্য তিনজন রয়েছেন আসামির তালিকায়।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামে দুদকের দায়ের করা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের যে ২১টি মামলা হয়েছে, তার আসামির সংখ্যা সর্বমোট ৩০ জন। এসব মামলার মধ্যে ১৪টিই হয়েছে সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে। যা শতকরায় ৬৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এই ১৪ মামলায় আসামি করা হয় ১৩ সরকারি চাকরিজীবী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের আট স্ত্রীকে। শতকরায় হিসেব কষলে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের মামলার যত আসামি তাদের ৪৩ দশমিক ৩৩ শতাংশই হচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবী। স্ত্রীসহ এ হার ৭০ শতাংশ।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি চাকরিরত অবস্থায় এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধভাবে এসব সম্পদ অর্জন করেন। নিজের পাশাপাশি স্ত্রীর নামেও সম্পদের পাহাড় গড়েন তারা। অভিযোগ পেয়ে দুদক তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু করে। যদিও গেলো দেড় মাস ধরে সংস্থাটির কমিশন না থাকায় আরও বহু মামলার অনুমতি মিলছে না বলে জানান তারা।
টিআইবি-সনাক চট্টগ্রামের সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, দুদকের করা দুর্নীতির মামলায় আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের সংখ্যা বেশি হওয়া এটা প্রমাণ করে যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে বেশি জড়িত। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষমতা দেওয়া হয় জনগণের কাজ করার জন্য। কিন্তু এক শ্রেণির লোক সেই ক্ষমতা অপব্যবহার করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তারা মনে করে যতই অপরাধ করুক, শাস্তির সম্ভাবনা অনেক কম। তাই দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করা হলেই দুর্নীতিবাজদের ভেতরে আতঙ্ক কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে কেউ দুর্নীতি করতে গেলে তারাও অনেক ভাবনা-চিন্তা করবে।
এদিকে দুদকসূত্র জানায়, দুদকে আসা অভিযোগের মধ্যেও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে ভূমি, এলএ শাখা, সিটি কর্পোরেশন, বিআরটিএ, পাসপোর্ট, বন্দর-কাস্টমস, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ, গ্যাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি পাওয়া যায়। এছাড়াও স্বাস্থ্য-শিক্ষা, ওয়াসা, সিডিএ, পরিবহন খাতের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। এ খাতগুলোতেই বেশি হয়রানি, অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এর বাইরে আলোচ্য সেবা সংস্থা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগও পাওয়া যায় বহু। এমন অবস্থায় সেবা সংস্থাগুলোর দিকে আরও বেশি তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।
পূর্বকোণ/ইব