আজ সোমবার টানেল উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হলো। তবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক নতুন শহর তৈরির স্বপ্ন নিয়ে টানেলটি নির্মাণ হলেও উদ্বোধনের একবছর পর সে স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে এখন। নির্মাণের আগে প্রতিবছর যত সংখ্যক যানবাহন চলাচলের সমীক্ষা ধরা হয়েছিলো সে সমীক্ষা থেকে অনেকটা দূরে টানেলে যানবাহন চলাচলের হিসাবনিকাশ। যে পরিমাণ অর্থ টানেলে আয় হচ্ছে তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা খরচ পোষাতেও পারছে না টানেল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে গত একবছরে টানেলের আনোয়ারা প্রান্থে বেড়েছে জমির দাম, উন্নত হয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা। বেড়েছে জমি বেচাকেনার হারও। কোরিয়ান ইপিজেড, কর্ণফুলী ড্রাইডক এবং ইউনাইটেড পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানিসহ বেসরকারি কিছু শিল্পকারখানা আনোয়ারায় বাড়িয়েছে বিনিয়োগ। কিন্তু প্রত্যাশার তুলনায় এটি এখনও অনেক কম। তাই টানেলকে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ বিলাসী এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। তিনি বলেন, কাল্পনিক সমীক্ষার ভিত্তিতে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে, যার বোঝা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে বয়ে বেড়াতে হবে।
টানেলের আয়-ব্যয় : ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর টানেলটি উদ্বোধনের পরদিন যানবাহন চলাচল শুরু হয়। উদ্বোধনের পর থেকে গত ২২ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় এক বছরের গাড়ি চলাচল ও আয় ব্যয়ের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে টানেল কর্তৃপক্ষ। এই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় এক বছরে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। যার মধ্যে মধ্যে ৭৬ শতাংশই ছিল হালকা যান বা ছোট গাড়ি। বাসের পরিমাণ ১০ শতাংশ, ট্রাক ১২ শতাংশ। আর অন্য বড় ট্রেইলারের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। টানেল কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে তিন হাজার ৯১০টি। টানেল কর্তৃপক্ষের দেয়া হিসাব বলছে, এখন পর্যন্ত গত এক বছরে এই টানেল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেল থেকে টোল বাবদ আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। কিন্তু মাটির তলদেশে নির্মিত টানেল হওয়ায় প্রতিদিন টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা বাবদ একটা বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেলটির এসব ব্যয় নির্বাহে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।
এখানে আয় ব্যয়ের হিসাব যদি করা হয় তাতে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা খরচ করে তার বিপরীতে আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এই বিশাল একটি প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরকারের লোকসান গুনতে হচ্ছে ২৭ লাখ ৯ হাজার হাজার টাকারও বেশি। চট্টগ্রামে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে : সর্বশেষ দুই অর্থবছরের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, টানেলের প্রভাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে সেভাবে আলো ফেলতে পারেনি এটি। উল্টো আগের অর্থবছরের তুলনায় সর্বশেষ অর্থবছরে চট্টগ্রামে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুসারে চট্টগ্রামে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য বিডায় নিবন্ধন নিয়েছে। অথচ এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছিল প্রায় ৫ হাজার ৭২৬ কোটি টাকার। এ হিসাবে গত অর্থবছরে এ অঞ্চলে বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ২ হাজার ২৭৫ কোটি ৭৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা বা ৩৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
কাল্পনিক সমীক্ষা : ২০১৭ সালের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় যান চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। প্রাক্কলন অনুযায়ী, চালুর পর দৈনিক গড়ে ২০২৫ সাল নাগাদ ২৮ হাজার ৩০৫টি ও ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৭ হাজার ৯৪৬টি যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। বর্তমানে চালুর প্রায় এক বছরের মাথায় দেখা যায় এই টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার যানবাহন চলাচল করছে। তাই বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী ২০২৫ সালে টানেল দিয়ে ৫ হাজার গাড়িও চলাচল করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। লোকসান কমতে সেতু সচিবের টানেল পরিদর্শন : প্রায় দশ হাজার সাতশো কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্প কেন এত লোকসান গুনছে তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। এর কারণ খুঁজতে গত শনিবার সেতু সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পরিদর্শনে এসেছেন। ঋণের টাকায় নির্মিত হওয়ায় এই প্রকল্প থেকে থেকে আয় তো দূরের কথা, প্রতিদিনের ব্যয়ও তোলা সম্ভব না হওয়ায় টানেলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এক গণমাধ্যমকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যোগাযোগ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, সঠিক সমীক্ষা ছাড়া একটি অবাস্তব প্রকল্প ছিল কর্ণফুলী টানেল। এখন কি করে এই লোকসান কমানো যায় আমরা সেই পর্যালোচনা করছি। টানেলকে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ বিলাসী, এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন বলে মন্তব্য করে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, কাল্পনিক সমীক্ষার ভিত্তিতে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে, যার নিষ্ফল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে বয়ে বেড়াতে হবে। ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ করার লক্ষ্যে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে অথচ কর্ণফুলী শাহ্ আমানত সেতুর মাধ্যমেই ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ বাস্তবায়ন হয়েছে। যে পরিমাণ অর্থ টানেলে ব্যয় করা হয়েছে সে অর্থ দিয়ে তিনটি উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করা যেত।
টানেলের পরিকল্পনাবিদদের জ্ঞানহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ধরনের একটি পরিকল্পনা করতে হলে যথেষ্ট জ্ঞানের প্রয়োজন, আবেগ দিয়ে পরিকল্পনা হয় না, এটা এখন ঋণ করে মিষ্টি খাওয়ার মতো হয়ে গেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পের জন্য ঋণ দিয়েছে তারাও এর দায় এড়াতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, আগে শিল্পায়ন করে পরে প্রয়োজন হলে টানেল কিংবা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা উচিত ছিলো, অথচ এখন উন্নয়নের আগেই প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে যেটা সবার ঘাড়ে বোঝা হিসেবে ভর করেছে।
টানেলের টোলের দায়িত্বরত বেলায়েত হোসেন বলেন, টানেল ফলপ্রসু করার বিষয়ে সেতু সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা টানেল পরিদর্শন করেছেন। বর্তমানে দৈনিক টানেলের আয় দৈনিক ১১ লাখ টাকার উপর, ব্যয়ের বিষয়ে আমাদের বলার সুযোগ নেই।
পূর্বকোণ/ইব