দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী। গেল ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর দলটির সামনে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সংগঠিত ও জনগণের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর সেই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে চায় সংগঠনটি।
গতকাল (২৫ অক্টোবর) রাতে এক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা জানান সংগঠনটির চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা ইউনিটের নবনির্বাচিত তিন আমির শাহজাহান চৌধুরী, আলাউদ্দিন শিকদার এবং আনোয়ারুল আলম চৌধুরী।
সম্মেলনের পর সারাদেশে একযোগে গত বৃহস্পতিবার জেলা ও মহানগর শাখার আমির নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী। সেই ফল অনুযায়ী চট্টগ্রাম উত্তর জেলায় নতুন মুখ এলেও পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর ও দক্ষিণ জেলার আমির। মহানগরে শাহজাহান চৌধুরী, উত্তর জেলায় আলাউদ্দিন শিকদার এবং দক্ষিণ জেলায় আনোয়ারুল আলম চৌধুরী ২০২৫-২০২৬ কার্যকালের জন্য আমির নির্বাচিত হয়েছেন।
শাহজাহান চৌধুরী
সাংগঠনিকভাবে আমাদের কোনো গ্যাপ নেই। নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত এবং নেতৃত্ব নির্ধারণ হয়। আগে এভাবে বড় পরিসরে ঘোষণা দিয়ে হয়নি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জনগণের কাছে এভাবে মুক্তভাবে নেতৃত্বের নাম ঘোষণা করতে পারাটা আমাদের বিশাল জনশক্তির মাঝে একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে। অতীতে আমাদের অনেক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ হয়নি। আমরা আগের মতোই সাংগঠনিক পরিকল্পনায় এগুবো। এখন জনগণ ও সংগঠনকে সংগঠিত করা ও জনগণের হৃদয়ের কথাগুলো অনুধাবন করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার বিশাল একটি সুযোগ আমাদের কাছে এসেছে।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি ইস্যুতে দলটির অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি আমানত রক্ষা করতে পারেননি, শপথ ভঙ্গ করেছেন, তিনি আর থাকার যোগ্যতা রাখেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেভাবে বলেছে, আমরাও সেভাবেই বলছি। এটা রাজনৈতিক ইস্যু, রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হবে।
দেশে সব মিলিয়ে উদ্ভূত অস্থিতিশীল পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৮ বছর দেশে আইনের শাসন ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যাংক খাতসহ সব খাতে দুর্নীতি হয়েছে। এরকম একটা গণঅভ্যুত্থানে নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডা, সুদান এসব জায়গায় বহুপ্রাণহানি হয়েছে। আমাদের দেশে প্রতিহিংসামূলক কোনো হত্যাকাণ্ড হয়নি। ১৮ বছরের জঞ্জাল অল্প সময়ে পরিষ্কার করা সম্ভব না। তবু মানুষ যেভাবে আতঙ্কে ছিল, সেখান থেকে দেশ ও জাতিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাঁচিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাও মাঠে ছিল। সবাই এগিয়ে আসছে, পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সবাই কাজ করছে। আমরাও দ্রব্যমূল্য কমাতে বাজারগুলোতে যাচ্ছি, সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি।
চট্টগ্রামবাসীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে জামায়াতের প্রভাবশালী এই নেতা বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরের জনসংখ্যা অনানুষ্ঠানিকভাবে এক কোটি হবে। আমি চট্টগ্রামবাসীকে বলব, আর কোনো ভেদাভেদ বা হিংসা বিদ্বেষ নয়, আসুন আমরা সবাই মিলে এই শহরকে একটি শান্তিময় আধুনিক বিশ্বের শহরের মতো প্রতিষ্ঠিত করতে ধৈর্য ধারণ করি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য আসেনি, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এসেছে। আমি চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষষের কাছে আকুল আবেদন জানাই সবাই যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন, আইন নিজের হাতে তুলে না নেন, ধৈর্য্য ধারণ করেন এবং এই সরকারের সবগুলো কাজকর্মের কথা তৃণমূলের কাছে পৌঁছে দেন।
আলাউদ্দিন শিকদার
প্রতি দুই বছর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলাম সাংগঠনিকভাবে নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করে। এবারও স্বাভাবিক নিয়মে সম্মেলনে নির্বাচনের পর বৃহস্পতিবার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এবার সময়টা ভিন্ন। এখন আমরা প্রকাশ্যে মুক্তভাবে কথা বলতে পারছি, মানুষের কাছে যেতে পারছি। আমাদের বক্তব্য সবার কাছে পৌঁছাতে পারছি, সবাই আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের গ্রহণও করছে। ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরশাসকের পতনের পর এই নতুন নেতৃত্ব নেতাকর্মীদের মাঝে একটা ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই ফেলবে। সাংগঠনিক কাজের গতি বাড়বে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ফ্যাসিবাদের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতি দায়িত্বে থাকতে পারেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ছাত্রজনতার এই আন্দোলন ছিল ফ্যাসিবাদীর বিরুদ্ধে। গণবিপ্লবে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে। এরপরও তো ফ্যাসিবাদের অংশ থাকতে পারে না। তাছাড়া তিনি বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন, এটা স্পষ্টতই শপথের লঙ্ঘন। আমাদের অবস্থান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এটা স্বাভাবিক সময় না, ছাত্রজনতার আন্দোলনের স্পিরিট ঠিক রাখতে হলে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির উন্নতির বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দাসহ উদ্ভূত পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৬ বছরের জঞ্জাল তিন মাসে উপড়ে ফেলা সম্ভব না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধ্বংস করে ফেলছে, পুলিশি ব্যবস্থাও পুরোটা নাজুক হয়ে গেছে। এটার জন্য সময় প্রয়োজন। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করতে হবে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দিকে মনযোগ দিতে হবে। আমরা উপদেষ্টার কাছেও আমাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছি।
আনোয়ারুল আলম চৌধুরী
জামায়াত অতীতেও নিয়মতান্ত্রিকভাবে যেভাবে পথ চলেছে, এখনো সেভাবেই চলবে। জেলা ও মহানগরীর আমির নির্বাচন হয়েছে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় এবং একই পরিবেশে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সব উপজেলা, থানা, ইউনিয়নসহ অধঃস্তন পর্যায়ে নির্বাচন সম্পন্ন হবে ইনশাআল্লাহ। কেন্দ্রীয় বার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে সবপর্যায়ে সাংগঠনিক মজবুত অবস্থান অর্জনের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনী সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। দেশ, জাতি ও মানবতার কল্যাণে যেকোন ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করবে জামায়াতে ইসলামী।
পূর্বকোণ/এমটি