বিপদ বাড়ছে হালদা নদীর স্বাদু পানির ডলফিনের। মূলত ইঞ্জিন চালিত যানে আঘাত, মাছ ধরা জালে আটকে পড়া, চর্বির সংগ্রহের জন্য হত্যা, দূষণের কারণে বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা সংক্রমণ এবং প্রাকৃতিকভাবে মৃত্যু- এ পাঁচ কারণেই মারা পড়ছে ডলফিন। বছর বছর মৃতের এ তালিকা আরো দীর্ঘ হচ্ছে। তাতে গত সাত বছরে হালদায় মারা গেছে ৪২টি ডলফিন।
জনসচেতনতা বাড়াতে বিগত ১৬ বছর ধরে আন্তর্জাতিকভাবে মিঠা পানির ডলফিন দিবস পালিত হলেও বাংলাদেশে অস্তিত্ব সংকটে হালদার ডলফিন। হালদাতে যে ডলফিনের বিচরণ স্থানীয়ভাবে এগুলোকে হুতুম বা শুশুক বলা হয়। বাংলা নাম গাঙ্গেয় ডলফিন। বাংলাদেশে এসব ডলফিন বিপন্ন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বিপন্ন ডলফিন। তাদের হিসাবে সারাবিশ্বের বিভিন্ন নদীতে এই গাঙ্গেয় ডলফিন আছে সবমিলে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০। সর্বাধিক ডলফিন থাকা চট্টগ্রামের হালদা নদীকেই এত দিন সবচেয়ে নিরাপদ আবাসস্থল বলে ধারণা করে আসছিল সংস্থাটি। কিন্তু তাদের এ ধারণা পাল্টে যাচ্ছে এখন। গত সাত বছরে শুধু এই নদীতেই ডলফিন মারা গেছে ৪২টি।
গবেষকরা বলছেন, নদীতে মাত্রাতিরিক্ত ইঞ্জিনচালিত নৌযান, মাছ ধরার জাল, দূষণ, অবৈধ শিকার ও ড্রেজার থাকলে বিপন্ন হয় ডলফিনের প্রাণ। নদীর নিম্নাংশে বালুতট, বিভিন্ন খাল এবং অন্য নদীর সঙ্গে সংযোগস্থলেই বেশি বিচরণ করে ডলফিন। হালদায় গত সাত বছরে যেসব ডলফিন মারা গেছে, তার ৯০ শতাংশেরই শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। জালে আটকা পড়া ডলফিন আধাঘণ্টার মধ্যে মুক্ত করা না হলে সেটির মৃত্যু হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গাঙ্গেয় ডলফিন রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এ প্রজাতির ডলফিন খাদ্য শৃঙ্খলে একটি তৃতীয় স্তরের প্রাণি এবং প্রজাতিটি নদী বাস্তুতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। যদিও বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো প্রধান নদীতে প্রজাতিটি পাওয়া যায়, কিছু উজানের নদীসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলো প্রজাতিটির একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল।
গাঙ্গেয় ডলফিন নদী সংরক্ষণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি, যাদের সুরক্ষা অন্যান্য নরম আবরণের কচ্ছপ, ঘড়িয়াল এবং মসৃণ-আবরণের শুশুকসহ বিস্তৃত জলজ এবং বিপন্ন প্রজাতির প্রাণিদের জীবনধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রজাতিটির সুরক্ষা এবং রক্ষণাবেক্ষণ নদীর বাস্তুতন্ত্রের আরও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে, যা প্রকারান্তরে নদীর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ স্থানীয় স¤প্রদায়কে উপকৃত করবে। এদিকে ২০১৭ সাল থেকে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর ডলফিন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন গবেষকরা। ২০১৮ সালে হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির জরিপ অনুযায়ী, হালদা নদীতে ডলফিন ছিল প্রায় ১৬৭টি। ২০২০ সালে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুনরায় জরিপ করা হয় হালদায়। তখন ডলফিন পাওয়া যায় প্রায় ১২৭টি। এর মধ্যে ৩৩টি মারা যায়। সর্বশেষ ২০২২ সালের জরিপে হালদায় ডলফিন মিলেছে প্রায় ১৪৭টি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশের ডলফিন প্রজাতির মাঝে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ডলফিন হলো শুশুক। বলা হয়, এরা সত্যিকারের নদীর ডলফিন। বিশেষ আকৃতির লম্বা ঠোঁট, পিঠে ছোট ডানা আর দুই পাশের বড় পাখনার কারণে সাগরের ডলফিন থেকে এরা কিছুটা ভিন্ন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, হালদা ও সাঙ্গু নদীর প্রায় সব জায়গাতেই শুশুকের বাস। স্বাদু পানির ডলফিন সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ২০০৯ সালের ২৪ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ায় বিশ^ব্যাপী স্বাদু পানির ডলফিন দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। শুশুকের প্রতি মানুষের ভালবাসা বাড়াতেই এ দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘নদীর প্রাণ ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক’।
শুশুক ছাড়াও বঙ্গীয় অঞ্চলে আরও কয়েক প্রজাতির ডলফিন নদী ও সাগর উভয় স্থানেই দেখা যায়। যেমন ইরাবতী ডলফিন। সুন্দরবনের মিঠা পানির নদী আর বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে এরা বাস করে। নদীসহ যেসব উপকূলীয় জলাশয়ে নদী থেকে মিঠা পানি আসে, সেসব স্থানে ইরাবতী ডলফিন দেখা যায়। সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের জনপথে এরা শুশুকের সঙ্গে মিলেমিশেই থাকে। এছাড়া, গোলাপি ডলফিন মাঝে মধ্যে সুন্দরবনের নদীতে দেখা গেলেও এরা আসলে উপকূলীয় জলভাগে বাস করে, যেখানে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদী থেকে মিঠা পানি আসে। এ প্রসঙ্গে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘হালদাতে বিপদে রয়েছে ডলফিন। ডলফিন রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ আমরা নানাভাবে কাজ করছি।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত শুধু হালদাতেই গত সাত বছরে ৪২টি ডলফিন মারা যায়। মূলত ৫ কারণে এসব ডলফিন মারা পড়ছে। বিপদে পড়া হালদার ডলফিন রক্ষায় এ মুহূর্তে ৮টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা দরকার। সুপারিশগুলো হচ্ছে- হালদায় ডলফিনের আবাসস্থলকে অভয়ারণ্য ঘোষণা, ড্রেজার ও যান্ত্রিকচালিত নৌকা চলাচল বন্ধ, জাল দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ, হালদা ও এর শাখা খালের রাবারড্যাম অপসারণ, বন্যপ্রাণী ও মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, সিসি ক্যামেরা দ্বারা নদী মনিটরিং এবং জনসচেনতা বৃদ্ধি।’
পূর্বকোণ/ইব