চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে চমেক-এর শাহ আলম বীরোত্তম হলে এক জম-জমাট অনুষ্ঠান হয় ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রোজ শুক্রবার। বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের এক বিশাল মিলনমেলা। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের ‘মেজবান’ অন্যতম উপভোগ্য ব্যাপার। এই অনুষ্ঠানের কয়েকটি ব্যতিক্রমী আবহ প্রশংসনীয়। তথ্যপ্রবাহের প্রচারণার একটি নেগেটিভ নেরেটিভের বিপরীতে তিন ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠপূর্বক অনুষ্ঠান শুরু।
কোন বিশেষ রাজনৈতিক বক্তব্যের অনুপস্থিতি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে এক নাটিকা। নাটিকাটিতে সংগ্রামী ছাত্র-ছাত্রীদের মর্মান্তিক আত্মত্যাগ সজিবভাবে ফুটিয়ে উঠেছে। নিশ্চিদ্র নিরবতায় দর্শকরা এই নাটকের উপজীব্য গ্রহণ করে ও অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। নাটিকাটিকে কোন রাজনৈতিক দর্শনে না ফেলে একটি সামাজিক আলোড়নকারী বিপ্লবের মঞ্চায়ন বলে মনে করা উচিৎ। কারণ প্রত্যেকের রাজনৈতিক মতামত থাকতে পারে। কিন্তু নাটককে নাটক হিসেবেই মূল্যায়ন করতে হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ডাক্তার সমাজকে একটা Inclusiveness এর মধ্যে এনে কেবল চমেক এর শেকড়ে কিছুক্ষণের জন্য আমোদিত করার প্রয়াস প্রশংসনীয়। চট্টগ্রামের ডাক্তার সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক মতামতের ঊর্ধে পেশাদারিত্বের ও ভ্রাত্রিত্ববোধের প্রকাশ অতীতেও এবং বর্তমানেও দেখা যায়। এটাই চট্টগ্রামের ডাক্তার সমাজের শক্তি। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার প্রচুর কমবয়সী ডাক্তারদের উপস্থিতি। বিগত কয়েক বছরের করোনা ওটালমাটাল রাজনৈতিক বাস্তবতার শেষে এধরণের প্রাক্তন ও নবীন ডাক্তারদের মেলবন্ধন আয়োজকদের জন্য প্রশংসার প্রাপ্তি।
১৯৪৫ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয়। তখন পুরো ইউরোপের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এই যুদ্ধ চলেছিল ছয় বছর। ততদিনে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ২২ বছর হয়ে গিয়েছে। ধনতান্ত্রিক বিশ্বের ফটকাবাজ মানুষ আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নিয়ন্ত্রিত জীবনের মানুষ। আরো সোজা ভাষায় একদিকে বিত্তবান, এলিট; অপরদিকে আম-জনতা, যারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। ২য় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকাতে ইউরোপে আরো দুই যুগ লেগেছে। এমন কোন প্রত্যন্ত অঞ্চল ছিলনা এই যুদ্ধ যাদেরকে ক্ষতিগ্রস্থ করেনি। তাই যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিকে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়াকে ‘বিপ্লব রেভুলিৎসিয়া’ নামে অভিহিত হয়। নতুন দেশ, নতুন প্রশাসন এটাই বড় কথা নয়। এসব দেশে এবং তৎপরবর্তী কিউবায় বিপ্লবের পর শোষণের অবসান হয়, সমাজ প্রশাসন ও দেশ পরিবর্তিত হয়েছে। আমূল পরিবর্তন হয় বিপ্লবে তার বিপরীত চিত্র দেখা গেছে পৃথিবীর অনেক দেশে, আর্জেন্টিনায় পেরেস, ফিলিপাইনে মার্কোস, ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো প্রমুখ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। শাসকদল ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছে। কিন্তু এসব দেশে শোষক-ধনীদের সাম্রাজ্য অটুট রয়েছে। হয়ত কিছু সংস্থার হয়েছে রাষ্ট্র-প্রশাসনে, কিন্তু সমাজ-বিপ্লব হয়নি। একইভাবে লিবিয়া, আলজিরিয়া, মিশর ও ইরানে কখনো আরব-বসন্ত কখনো ইসলামী জাগরণ এর নামে এক শাসক উৎখাত হয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়েছে।
কিন্তু সমাজ-গরীব-ধনীর সম্পদ-কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি। এরকম মৌলিক পরিবর্তন আশাও করা যায় না। কারণ যাদের মুখ্য ভূমিকায় এরকম পরিবর্তন হয়, তাদের রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন চাহিদা হলেও সমাজ-কাঠামো ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার কোন এজেন্ডা থাকে না। প্রায় ৮০ বছর পূর্বের বিপ্লবপরবর্তী পূর্ব ইউরোপের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা-কাহিনী বর্ণনা করেন এমন অনেক বৃদ্ধ এখনো পাওয়া যায়। ২০২৩ সালে এমনি এক বৃদ্ধ আমাকে কাহিনীর পর কাহিনী শোনায়, কোথায়, কোন জায়গায় বুর্জোয়া, বিপ্লববিরোধীদের কিভাবে বিনাবিচারে হত্যা করা হয়। যুদ্ধে যত লোক মারা যায়, বিপ্লবের পরেও লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়। এটা মাও সে তুং এর চীনেও ঘটেছে। প্রতিবিপ্লবী, বিপ্লববিরোধীদের হত্যা সেই সময় বিপ্লবের একটা অবধারিত অনুসঙ্গ ছিল। আমাদের দেশে ৫ আগস্ট যে অভুতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে তার পুরোধা হচ্ছে ছাত্র। পরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মৌন সমর্থন থাকলেও রাস্তায় নেমে আসে একটা সচেতন জনতা। ছাত্র-ছাত্রীর নেতৃত্বে সরকার উৎখাত সাম্প্রতিক বিশ্বে প্রথম ঘটনা। এই ছাত্র আন্দোলন এর রিপ্লিকা হয়েছে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে। অনেক রাজনৈতিক পন্ডিত পাশ্চত্যবিশ্বে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বিপ্লব নিয়ে বিশ্লেষণমুখী গবেষণা শুরু করেছেন।
রাজনৈতিক ন্যারেটিভে এই বিপ্লবের কয়েকটি পরিভাষা লক্ষণীয়। ‘বৈষম্য বিরোধী’ সংস্থার, নতুন বাংলাদেশ ইত্যাদি। এসব পরিভাষার বাস্তবায়ন জরুরী। কিন্তু কথা থেকে যায় এই আন্দোলনের বাতাস আম-জনতার প্রকৃত সমস্যাগুলোকে কতটুকু ছুইয়ে যাবে। ১৫ বছরের অনিয়ম, দুর্নীতি, গুম, হত্যার মামলা হচ্ছে, কিন্তু বিপ্লবপরবর্তী এসব পদক্ষেপের দ্রুততম বাস্তবায়ন সময়ের দাবী। এক্ষেত্রে আইনী পরামর্শকদের নিয়ে দ্রুততম সময়ে বা আগের যুগের ‘সামারী মিলিটারী কোর্ট’ স্টাইলে দ্রুত বিচার সম্পাদন করা যেতে পারে। নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিছু কমিশন করা হয়েছে। এগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন। যুবসম্প্রদায়ের প্রধান সমস্যা শিক্ষার পর চাকুরী প্রাপ্তি। গ্রামে-গঞ্জে কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স আছে। গরীবরাও সন্তানকে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। প্রত্যেক মা-বাপই সন্তানের শিক্ষা লাভের পর একটা চাকুরী আশা করে। কিন্তু যুবসম্প্রদায়ের চাকুরীর বাজার শোচনীয় বাবে সীমিত। বাংলাদেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার মাঝে চাকুরী প্রাপ্তিতে হতাশা। তাই প্রতিটি জেলা-উপজেলা ইউনিয়নে শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত যুবকদের জন্য চাকরী সেবা কেন্দ্র (Employment Center) থাকতে হবে। এসব কেন্দ্রে চাকুরী প্রার্থীদের একটা ডাটাবেজও থাকতে পারে। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরীর সন্ধান দেবে এসব কেন্দ্র। দেশের সমস্ত সরকারী-বেসরকারী চাকরীদাতা দৈনিক চাকরীর ফিডব্যাক এসব কেন্দ্রে পাঠাবে।
মানুষের চাকুরী না থাকলে আয় থাকবে না। আয় না থাকলে একটা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। সামাজিক অস্থিরতায় কোন উন্নয়নই টেকসই হবে না। ধরুন সুষ্ঠ নির্বাচন হল, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মূলক এক-কক্ষ বা দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদও হল। আম-জনতার সন্তানদের চাকুরীর বাজারে তার কি সংশ্লিষ্টতা বা প্রভাব থাকতে পারে? উত্তর হয়ত ‘সামান্য’ বা ‘কিছুই না’। এখানেই আসে বিপ্লবপরবর্তী ফল-লাভের বহুমাত্রিকতা। একটা রোগীর জীবনে সর্বোচ্চ আকাক্সক্ষা রোগমুক্তি। একজন শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত-অশিক্ষিত যুবকের একমাত্র আশা চাকুরী প্রাপ্তি। তাই বিপ্লব সমর্থিত সকল সংস্কার এক নম্বর করণীয় যুবসম্প্রদায়ের চাকরীর সুযোগ সৃষ্টি।
বুর্জোয়া অর্থনীতিতে নিজ উদ্দ্যেগ, স্ব-উদ্যোক্তা ইত্যাদি পরিভাষা চালু আছে। আমাদের মত বৈষম্য পুণ পুজিবিহিন পরিবারের সন্তানদের জন্য এস পরিভাষা ও কষ্টদায়ক। দু-একটা স্ব-উদ্যোগের সাফল্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তার কোন জাতীয় নেরেটিভ মূল্য নেই। বরং এটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায় এড়ানোর নামান্তর মাত্র। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস স্যার (আমরা চট্টগ্রামের ইউনুস সুহৃদ বা Friend of Younus তাকে ‘স্যার’ বলে সম্মোধন করি) এর বিপ্লবপরবর্তী সাফল্যের খতিয়ান অনেক। আর্ন্তজাতিকভাবে দুবাইতে দন্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশীদের জেলমুক্তি একমাত্র নোবেল-বিজয়ী দ্বারাই সম্ভব ছিল। এজন্য পৃথিবীর সর্বত্র শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত অনেক শ্রমিক প্রয়োজন। তাঁর আর্ন্তজাতিক কানেকশন এর সুবাদে ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ হিসেবে যুবসম্প্রদায়ের জন্য চাকুরী প্রাপ্তির সুযোগ করে দেয়া জাতির একটি বড় প্রত্যাশা। ৫ আগস্টের বিপ্লবের সফলতার কাহিনী যেন পরবর্তী প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহমান থাকে। ’৬৭ প্রজন্মের নবীন ও প্রবীন ডাক্তারদের মেলবন্ধনের আনন্দঘন একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আয়োজকরা প্রশংসার দাবী রাখে। মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটিকা যেমন ৫২ এর ছাত্র আন্দোলনকে ইতিহাস এর ফ্রেমে আটকে রেখেছে, তেমনি চমেক এর ৬৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ‘জুলাই-বিপ্লব’ নাটিকাও ইতিহাসের ফ্রেমে চিরায়ত হয়ে থাকবে।
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
পূর্বকোণ/এএইচ