চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

সাক্ষাৎকারে এআই অলিম্পিয়াডে রৌপ্যজয়ী মিসবাহ উদ্দিন ইনান

প্রতিভার পরিচর্যা হলে আইটি খাতে নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ

আরাফাত বিন হাসান

২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ

“এআই অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ ছাড়া মাত্র দুটো দেশ চারটি করে মেডেল পেয়েছে।বিশ্বের অন্যতম নামকরা এই এআই সামিটে সেরা গবেষকদের সামনে আমরা চার তরুণ বাংলাদেশের পতাকা নতুন করে চিনিয়েছি। এটা আমাদের জন্য গৌরবের।”
সম্প্রতি সৌদি আরবের রিয়াদে আন্তর্জাতিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ স্কোর করে রৌপ্যপদক জিতেছে চট্টগ্রামের ছেলে মিসবাহ উদ্দিন ইনান। পুরো বিশ্বের ঢাকার নটরডেম কলেজের এই ছাত্রের অবস্থান ১৬। শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নয়, ইনানের পাকা হাত রোবটিক্সেও। গেল চার বছরে ছোটবোন জাইমা জাহিন ওয়ারাসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে ৬টি স্বর্ণপদকসহ ১৬টি পদক জিতেছে। কয়েকবছর আগে ইংলিশ অলিম্পিয়াডেও জাতীয় পর্যায়ে পদক জিতেছিল ইনান। তার এসব অর্জন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার গল্প শুনেছেন আরাফাত বিন হাসান। 
 
পূর্বকোণ: রোবটিক্স আর এআইয়ের প্রতি আগ্রহ কখন থেকে, কীভাবে?
ইনান: রোবটিক্স আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রতি আমার আগ্রহ শুরু হয় প্রাথমিকে পড়ার সময়। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি ওয়ার্কশপে গিয়ে কোডিং বা প্রোগ্রামিং সম্পর্কে জানতে পারি। সেই সুবাদে রোবটিক্স সম্পর্কেও ধারণা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) যে বিপ্লব, সেটা দেখেই এটা নিয়ে কাজের আগ্রহ জাগে। কাজ শুরুর পর এআইয়ের প্রতি আমার প্যাশন তৈরি হয়।
পূর্বকোণ: বিশ্বমঞ্চে জন্মভ‚মির প্রতিনিধিত্ব করতে কেমন লাগে?
 
ইনান: সারা বিশ্বের সামনে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে যখন একটা স্বীকৃতি পাই, তখন অন্যরকম ভালো লাগার অনুভ‚তি কাজ করে। এটা বলে বোঝানো সম্ভব না। 
 
 
পূর্বকোণ: পড়াশোনার পাশাপাশি সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে কেমন বাধার সম্মুখীন হন?
 
 
ইনান: আমাদের একাডেমিক সিলেবাসে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা প্রোগ্রামিংয়ের বিস্তারিত ধারণা নেই। দুটো আলাদা। তবে আমি যখন এআই বা রোবটিক্স নিয়ে কাজ করি, সেখানে একাডেমিক পড়াশোনার যতটুকু কাজে লাগানো যায়, তার সর্বোচ্চটুকুই কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। হ্যাঁ, এটা সত্য যে দুটো একসঙ্গে ম্যানেজ করা কঠিন। কিন্তু চেষ্টা করলে সম্ভব।
 
 
পূর্বকোণ: রোবট আর এআই অলিম্পিয়াডের ধাপগুলো কীভাবে সম্পন্ন হয়?
ইনান: রোবট অলিম্পিয়াডের ক্ষেত্রে ফেসবুকে রেজিস্ট্রেশনের তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিবছর একটা মূল থিম থাকে। সেটা অনুযায়ী রোবট বানাতে হয় এবং কোন ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণ করব সেটা নির্ধারণ করতে হয়। গুগল ফরম পূরণের মাধ্যমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। সেখানে নিয়মাবলিও দেওয়া থাকে, সেগুলো দেখে শুরুতে জাতীয় পর্ব, পরে সিলেকশন ক্যাম্প, এরপর বাছাই হয়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ। এআই অলিম্পিয়াডও অনেকটা একই।
 
 পূর্বকোণ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
 
 
ইনান: আমার সফটওয়্যার সম্পর্কিত গবেষণায় আগ্রহ। বড় হয়ে আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা এজিআই বাস্তবায়নের কাজে অংশগ্রহণ করতে চাই। আসলেই এটার বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব কিনা সেটা গবেষণায় আগ্রহী।
 
 
পূর্বকোণ: আপনার ছোটবোনও রোবট অলিম্পিয়াডে অনেক পদক জিতেছে, সেও কী আপনার কাছেই এসব শিখেছে? 
ইনান: আমার বোন এখনও ছোট। সে রোবট অলিম্পিয়াডে পরপর তিন বছর গোল্ড এবং সিলভার মেডেল অর্জন করেছে। এই বিষয়গুলো কিন্তু তার একাডেমিক সিলেবাসে নেই। করোনার লকডাউনে আমি রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের প্রথম সিদ্ধান্ত নিই। তখন কাউকে না পেয়ে তাকেই টিমমেট হিসেবে নিই। শুরুতে মনে হয়েছিল সে তো অনেক  ছোট, আদৌ পারবে কিনা। কোডিংয়ের কঠিন বিষয়গুলো সে না বুঝলেও রোবট ডিজাইন, ফাংশন, আইডিয়া জেনারেশন- এগুলো  খুব ভালো পারে সে। আমি মনে করি, ছোটদের আইডিয়া জেনারেশন দক্ষতা খুবই সতেজ থাকে। 
 
 
পূর্বকোণ: পুরো জার্নিতে শিক্ষকদের কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?
ইনান: আমার শিক্ষকদের সহযোগিতা ছাড়া এত কিছু কখনই সম্ভব হতো না। তারা সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। শিক্ষকদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। 
 
 
পূর্বকোণ: আপনি ইংলিশ অলিম্পিয়াডেও প্রাইজ জিতেছিলেন….
ইনান: আমি ২০২০ সালে দ্বিতীয় ইংলিশ অলিম্পিয়াডে স্মল স্টার গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ওটা পুরোটাই স্পিকিং নির্ভর ছিল, রোবট বা এআই অলিম্পিয়াডের চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিকের। আমি এখন যে কোন জায়গায়, যেকোনো পরিস্থিতি কথা বলতে পারি-এই বিষয়টি ইংলিশ অলিম্পিয়াডে শিখেছি। 
 
 
পূর্বকোণ: অবসর সময়ে আপনি কী করেন?
ইনান: অবসর সময়ে বই পড়ি। এর বাইরে কোডিং করি বা কোন প্রজেক্টের আইডিয়া মাথায় এলে সেটা আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করি। 
 
 
পূর্বকোণ: আপনার একাডেমিক পড়াশোনা নিয়ে যদি বলতেন।
 
 
ইনান: আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরেই। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে মাধ্যমিক শেষ করে নটরডেম কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ সবসময় প্রথম তিনে ছিলাম। 
 
 
পূর্বকোণ: এআই আর রোবট অলিম্পিয়াডে রেজাল্ট শোনার পরমুহূর্তে আপনার অনুভ‚তি কেমন ছিল?
ইনান: প্রথম রোবট অলিম্পিয়াডের রেজাল্ট শোনার পর আমি রীতিমতো কান্না করে দিয়েছিলাম। রোবট অলিম্পিয়াডে কিছু প্রতিক‚লতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। আমাদের একটা পরিকল্পনা সাজানো ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দেখা গেল টিমের একজন ভিসা পায়নি। তখন মনে হয়েছিল আমরা অথৈ সাগরে। দীর্ঘদিন একটা পদ্ধতিতে প্র্যাকটিস করেছি। কিন্তু চুড়ান্ত প্রতিযোগিতার দুদিন আগে পুরো প্ল্যান ভেস্তে যায়। বাবা-মা তখন অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। সব প্রতিক‚লতা পেরিয়ে যখন পদক জিতেছি, তখন আপনাআপনি চোখে পানি চলে এসেছিল। আর এআই অলিম্পিয়াডে চারজনের টিমে আমরা সবাই মেডেল পেয়েছি। আমার জানামতে, বাংলাদেশ ছাড়া মাত্র দুটো দেশ চারটি করে মেডেল পেয়েছে। বিশ্বের অন্যতম নামকরা এই এআই সামিটে সেরা গবেষকদের সামনে আমরা চার তরুণ বাংলাদেশের পতাকা নতুন করে চিনিয়েছি। এটা আমাদের জন্য গৌরবের। 
 
 
পূর্বকোণ: সামগ্রিকভাবে আইটি খাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন দেখেন?
ইনান: বাংলাদেশের যে মেধা আর প্রতিভা আছে, আমরা তাদের যদি ভালো নার্সিং আর প্রোপার ট্রেইন করতে পারি তাহলে বাংলাদেশ আইটি ফিল্ডে নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশের এই উজ্জ্বল ভবিষ্যতে আমিও কাজ করতে চাই।
 
 
পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট