চট্টগ্রাম সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইউসূফ চৌধুরী স্বীকৃতি মানেই চট্টগ্রামের স্বীকৃতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

ইউসুফ চৌধুরীর অভাব পূরণ হওয়ার নয় : ড. মুহাম্মদ ইউনূস

আসসালামু আলাইকুম। আজকে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনারা সবাই এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে আমি নিজে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলাম না বলে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র জনাব ইউসুফ চৌধুরী আজ আর আমাদের মাঝে নেই। হঠাৎ করেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এত হঠাৎ করে যে চলে যাবেন, এটা আমার কল্পনাতেও আসে নাই।

তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন কিছুদিন আগে যখন আমি চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর সবাই উৎসব করছেন। এই উৎসবে উনিও শরীক হয়েছেন। তিনি এসেছিলেন অভিনন্দন জানাতে। অসুস্থ শরীর নিয়ে। কিন্তু আশা করিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।
দেখা করতে এসেছিলেন একটি বিশেষ অনুরোধ নিয়ে। বলেছিলেন, আমাকে উনার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। নজরুল জয়ন্তী উৎসব হবে। সেখানে অবশ্যই আমাকে যেতে হবে। তিনি গ্রামে নজরুল পাঠাগার সৃষ্টি করেছিলেন যার উদ্বোধন করতে হবে। আমাকে ছাড়া তিনি তা উদ্বোধন করবেন না। তিনি অনেকটা জেদ ধরলেন যে, আমাকে আসতেই হবে। কথা দিয়ে যেতে হবে, আমি নজরুলজয়ন্তী উৎসবে শরীক হব। আমি তাঁকে বোঝালাম আমার নানা কর্মসূচি তৈরি করা আছে। কিছুদিনের মধ্যে আবার আমাকে চট্টগ্রাম আসতে হবে। অবুঝ শিশুর মতো বসে রইলেন। তাঁর মনের একটা সাধ যে, আমাকে নিয়ে যাবেন। এবং সবার সামনে আমাকে উপ’িত করবেন। আমি কথা দিলাম। আমি অবশ্যই আসবো। তবে কিছুদিনের মধ্যে সময় হবে না। কিছুটা সময় আমাকে দিতেই হবে। আমি অবশ্যই যাবো। নজরুলজয়ন্তী কিংবা নজরুল পাঠাগার উদ্বোধন হোক, তাতে আমি উপস্থিত থাকবো। উনি যে খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন তা নয়। কিন্তু মেনে নিলেন। তিনি চলে গেলেন, আমি মনে মনে ওয়াদা পালন করব বলে ঠিক করলাম। তাঁকে যে কথা দিয়েছি সে ওয়াদা পালন করবো। সে ওয়াদা আর পালন করা হয়নি। তিনি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।

ইউসুফ চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক আগের। ইউসুফ চৌধুরী সাহেবকে আমি চিনি অনেক দিন আগে থেকেই। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল। আমি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলাম। এই প্রথম এমএ স্কুল ছেড়ে দূরের স্কুল কলেজিয়েট স্কুলে গেলাম। আর সেই স্কুলে যাবার পথে ছিল তাঁর নিউজ ফ্রন্ট। কখনও কখনও সেই বইয়ের দোকানে যেতাম। সেটা পরে অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। একবার না গেলে খারাপ লাগত। নিউজ ফ্রন্ট বাচ্চাদের একটা গন্তব্যে পরিণত হয়। এখন চিন্তা করি, কেন নিউজ ফ্রন্ট আমাদের এত আকর্ষণ করেছিল। কারণ, সেখানে বিভিন্ন সেরা পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই পাওয়া যেত। যা কেনার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। আমরা পাতা উল্টাতাম। ছবি দেখতাম। এই প্রথম রিডার্স ডাইজেস্ট দেখলাম। রিডার্স ডাইজেস্টের প্রতিনিধি ছিলেন ইউসুফ চৌধুরী। ‘ডন’ পত্রিকা আসত পাকিস্তান থেকে। আমরা কিশোররা যা দেখতাম। পাতা উল্টাতাম। অবাক লাগত দেশি-বিদেশি পত্রিকার এমন একটা দোকান কেন এই ভদ্রলোক দিলেন। বুঝতাম না। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে কাটাতাম। কোনদিন তিনি বলতেন না, তোমরা সরে যাও। লোক আসতে দাও। ধৈর্যসহকারে আমাদের দেখতেন। কোনদিন পত্রিকা কিনতাম না। কিনার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। ১৯৫২-৫৫ সালে নিয়মিত গিয়েছি নিউজ ফ্রন্টে। ইউসুফ চৌধুরী স্বল্পভাষী মানুষ। কথা বলতেন কম, মৃদু হাসতেন। কে আসলো কে গেল খবর নিতেন। আমরা আসলে বরং খুশি হতেন। সেই থেকে উনার সঙ্গে পরিচয়।

দেখলাম উনি সিগনেট প্রেস করেছেন। কিছুদিন পর জানলাম উনি প্যাকেজিং করেছেন। আমি নিজেই প্যাকেজিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তাই ভালই লাগলো। একটার পর একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন তিনি। দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকা করলেন। চমৎকার একটি পত্রিকা-সফলও হচ্ছেন।

ইউসুফ চৌধুরী স্বল্পভাষী মানুষ। কর্মপাগল মানুষ। আমরা উদোক্তা নিয়ে কথা বলি। ইউসুফ চৌধুরী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না। উনি একজন বিশেষ উঁচু মাপের উদ্যোক্তা ছিলেন। যেসব কাজে হাত দিয়েছেন তার একটারও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। নিউজ ফ্রন্ট করেছিলেন হয়তো মানুষ পত্রিকা পড়তো বলে। প্যাকেজিং চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সুন্দরভাবে চালিয়েছেন। আমরা অবাক হতাম, কত সুন্দরভাবে উনি সব চালাচ্ছেন, তা দেখে। তারপরও আরও অনেক কিছু উনি করেছেন। সামাজিক কাজে যুক্ত হয়েছেন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ছিল।

এই যে একজন নীরব কর্মী সর্বক্ষণ নতুন নতুন চিন্তা করছেন। আপন মনে কাজ করছেন। অনেক করে ঝুঁকি নিচ্ছেন। চট্টগ্রামে বসে উনি যেসব কাজ করেছেন, আমাদের অবাক লাগত। সারা বাংলাদেশে যা প্রভাব বিস্তার করেছে। এরকম একজন লোক নীরবে চলে গেলেন। সেই অভাব চট্টগ্রামের তো পূরণ হবেই না, বাংলাদেশেরও হবে কিনা সন্দেহ। তাঁর স্মৃতি আমাদের কাছে অনেক দিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। বিশেষ করে আমরা যারা কিশোর তাঁর দোকানে ভিড় করতাম, তাঁর সৌজন্যে আমরা সেরা কাগজের পাতা উল্টাতাম। ঠিক বেড়ে ওঠার সময় আমরা যখন তরুণ-কিশোর, তাদের বেড়ে ওঠার কাজে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুক। তিনি যে কর্মকা- রেখে গেছেন, তা আরও অমর হোক। তাঁর স্মৃতি অক্ষয় থাকুক।
চট্টগ্রামে তাঁর যে অবদান-বাংলাদেশে তাঁর যে অবদান, সেটা সবার মধ্যে বেঁচে থাকুক। সবাইকে ধন্যবাদ।

লেখাটি মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী নাগরিক শোকসভা পরিষদ, চট্টগ্রাম কর্তৃক ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর প্রকাশিত চট্টলদরদী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী স্মারক সংকলন ‘সম্পূর্ণ মানুষ’ থেকে সংগৃহীত।

আবুল মোমেন

দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীকে আমি শৈশবকাল থেকে চিনতাম। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথম দিকে যখন চুনার গুদাম পেরিয়ে কলেজিয়েট স্কুলে যেতাম তখন রাস্তার পাশে নিউজফ্রন্ট নামের বইয়ের দোকানটি আমাদের আকৃষ্ট করত। দেশি-বিদেশি নানা বই ও পত্রপত্রিকা সজ্জিত এ দোকানে একবার ঢুকতে চেয়েছি বহুদিন। শেষে সাহস করে একদিন ঢুকে পড়ি। সেখানেই প্রথম দেখি ইউসুফ চৌধুরীকে। ফর্সা গোলগাল মানুষটিকে বইয়ের রাজ্যে আকর্ষণীয় ব্যক্তি বলে মনে হতো। এর আরো পরে যখন তার কাছে বাবার প্রতিনিধি হিসেবে যাই তখনো আমি স্কুলের ছাত্র। বাবার শ্রেষ্ঠ গল্পের বইটি ইউসুফ সাহেবের দোলনা প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল। তখন আমাদের দোতলা বাসা তৈরি হচ্ছিল। নির্মাণ কাজে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য বাবা আমাকে পাঠাতেন প্রকাশক ইউসুফ চৌধুরীর কাছে। তখন ১০০ টাকারও অনেক দাম ছিল। কারণ এক বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল মাত্র ৭ টাকা। সেইভাবে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূত্রপাত হয়। প্রথমে চুনার গুদামের নিউজফ্রন্টে, তারপরে তামাকুমন্ডি লেনে সিগনেট প্রেসের অফিসে এবং আরো পরে রাস্তার বিপরীত দিকে কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি ভবনের দোতলায় সিগনেটের আধুনিক অফিসে। সেখানে ৮০’র দশকে পত্রিকা প্রকাশের লক্ষ্য নিয়ে তার সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ শুরু হয়। ইউসুফ সাহেব ঢাকা, কলকাতা ও করাচির বিভিন্ন পত্রিকার এজেন্ট ছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি বড় বড় পত্রিকা অফিসে ব্যক্তিগতভাবে গেছেন এবং মনের মধ্যে নিজের একটা পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা পোষণ করতেন।

এদিকে আমাদের সকলেরই ইচ্ছা ছিল চট্টগ্রাম থেকে একটা আধুনিক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের। তাঁর স্বপ্ন এবং আমাদের ইচ্ছা এক জায়গায় মিলিত হয়েছিল সেই ৮০’র দশকের গোড়ায়। তবে তখনকার রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পত্রিকার ডিক্লেয়ারেশন পাওয়া সহজ ছিল না। ফলে পত্রিকার প্রকাশ কেবল বিলম্বিত হয়েছে। মনে পড়ে পত্রিকার নামকরণের জন্যে ইউসুফ সাহেবের পরামর্শে আমি শিশির দত্ত ও তার দ্বিতীয় পুত্র জসিম উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামানের বাসায় গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত নাম সাব্যস্ত হয় ‘দৈনিক পূর্বকোণ’। এভাবে আমাদের ও জনাব ইউসুফ চৌধুরীর স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল।

মরহুম ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষ। ছোট আকারে পত্রিকার এজেন্সি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে তিনি যেমন বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তেমনি নিজেকেও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকশিত করেছেন। একইসাথে সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারেও যথাযথ যতœ নিয়েছেন। আজকের দিনে তার প্রকাশিত পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণ সমাজের যথার্থ বিকাশে ভূমিকা রেখে চলেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিশ্চয়ই চলমান থাকবে, তবে পূর্বকোণ সামাজিক ও জাতীয় দায় পূরণ করে তাঁর স্বপ্ন ও স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী

স্বনির্ভর চট্টগ্রাম ও ইউসুফ চৌধুরী। এই ‘স্বনির্ভর’ শব্দটা একমাত্রিক হলেও মরহুম মো. ইউসুফ চৌধুরীর ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক। মহতী মানুষদের তালিকায় ইউসুফ চৌধুরীর মতো বহুমাত্রিক স্বনির্ভর ব্যক্তি খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তাঁর কাজের বিস্তৃতিও ছিল বহুমাত্রিক। যার মধ্যে ছিল প্রকৌশল, শিক্ষা, পশু চিকিৎসা বিজ্ঞান, পরিবেশ, ডেইরি ও পোল্ট্রি শিল্প এবং এরসঙ্গে বড় একটি বিষয় প্রকাশনা।
স্বনির্ভর চট্টগ্রামে তাঁর রয়েছে বহুমাত্রিক অবদান। তার ইন্টেলেকচুয়াল দিকটা খুবই স্ট্রং ছিল। যে কোন বিষয় বা সমস্যা তিনি শুরুতে ধরে ফেলতে পারতেন। কাউকে গিয়ে বোঝাতে বা কনভিন্স করতে হতো না। চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয় তার ইউনিক ভাবনা। কারণ পুরো দুনিয়াতে যেটা নেই, সেটা এখানে কীভাবে হবে? এরকম প্রস্তাব দিব কীভাবে? কিন্তু তিনি এটা করে দেখিয়েছেন। ২০০১ সালে বিআইটিকে বিশ^বিদ্যালয় করার আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। স্বনির্ভরতায় এসব তাঁর সম্মিলিত অবদান।
সমাজের এসব কাজ করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেকেই নিজের পরিবার বা পরবর্তী প্রজন্মের খবর নিতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তার পরের জেনারেশনও স্ট্রং হলো। তিনজনই সুপুত্র। এদিক থেকে মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর জীবনের পূর্ণাঙ্গতা আছে।
প্রাণিসম্পদের তার অবদান ছড়িয়ে গেছে গোটা দেশেই। প্রাণিসম্পদ তো কেবল জীবিকা উপার্জন নয়, এটা বিশাল একটা শিল্প। এই শিল্প এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো শহরে। কাজেই অর্থনীতিতে অবদান বিবেচনায় তিনি একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব।
উনার মৃত্যুর ১৭ বছর পূর্ণ হয়েছে। এ সময়টা কিন্তু আমরা অপচয় করেছি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে একটি চেয়ার করতে পারলে ভালো হয়। তবে তিনি যেহেতু চট্টগ্রামেরই সন্তান, আমি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়কে বেশি গুরুত্ব দিব। চবি, সিভাসু, চুয়েট এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার করা খুব বেশি কঠিন না। চেয়ারটা থাকা দরকার। বিল্ডিং আর চেয়ারের পার্থক্য হলো চেয়ারের সঙ্গে শিক্ষা সরাসরি যুক্ত থাকে। চাইলে প্রফেসরশিপও স্পন্সর করা যায়। আরেকটি বিষয় হলো তার যা ডকুমেন্ট আছে, সেসব আর্কাইভের ব্যবস্থা করা। একটা ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্ট হওয়া উচিত, নিউজের বাইরে একটা ডকুমেন্টারি হওয়া উচিত। যেহেতু তার বহুমাত্রিক অবদান আছে, এক একটা সেক্টর নিয়ে আলাদা আলাদা সাপ্লিমেন্ট করা যায়। সব মিলিয়ে তিনি একজন পরিপূর্ণ পুরুষ। শিক্ষা যে স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি, তা না। আসল শিক্ষা যে কোন জায়গায় এসব ব্যক্তিরাই তার প্রমাণ।

অধ্যাপক ড. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ

যেভাবে আমি মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীকে অনুভব করি সেভাবে তাঁর ব্যাপকতা মানুষের কাছে আমি তুলে ধরতে পারিনি। সবসময় আমি সেই শূন্যতা অনুভব করি। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের গভীরতা বলে প্রকাশ করা যাবে না। ইউসুফ চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় নোমান সাহেব সিলেট কলেজের সঙ্গে ভেটেরিনারিও একটা কলেজ করতে বলেন। তখন একটা প্রকল্পে ভেটেরিনারি নাম যুক্ত করে চট্টগ্রাম ও সিলেটে ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ভেটেরিনারি কলেজকে বিশ^বিদ্যালয় করার যৌক্তিকতাও তিনি বিভিন্নজনের কাছে তুলে ধরেছেন। তাঁর চিন্তার গভীরতা ছিল অনেক। তিনি সবসময় এটা নিয়ে ভাবতেন। কিভাবে এটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। ইউসুফ চৌধুরী সুদূর-প্রসারী চিন্তাভাবনার একজন মানুষ। তিনি ছিলেন খুবই দক্ষ ও বিচক্ষণ প্রকৃতির। নিজে একটা আলাদা বিশ^বিদ্যালয়। এতো দৃঢ়শক্তিমান ব্যক্তি খুবই কম আছে। যেকোনো কিছু বললেই তিনি বুঝে ফেলতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। অনেক জ্ঞানী মানুষকে ইউসুফ চৌধুরী ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। ইউসুফ চৌধুরীর গড়ে তোলা সামাজিক আন্দোলনের কারণে দলমত নির্বিশেষে সবার চাওয়া হয়ে উঠেছিল ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয়। ইউসুফ চৌধুরী নিয়ে শুধু পূর্বকোণের নয়, জানা উচিত নতুন প্রজন্মেরও। প্রতিটি প্রজন্ম ইউসুফ চৌধুরীদের মতো মানুষদের কাছ থেকে শিখবে। ইউসুফ চৌধুরী শুধু চট্টগ্রামের নয়, পরবর্তী জেনারেশনের জন্য তাঁর নিজস্ব পরিচিতি বহন করে। এটা খুবই একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় যে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর নামে চেয়ার হতে পারে। ইউসুফ চৌধুরীর প্রত্যেকটি বিষয় তুলে আনা উচিত। তাকে নিয়ে গবেষণা দরকার। প্রয়োজনে আমরা সময় দিতে চাই। এছাড়াও ইউসুফ চৌধুরীর কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় তাঁর নামে একটা ফাউন্ডেশন করা যেতে পারে। ইউসুফ চৌধুরী একটা ইনস্টিটিউটের নাম। এটাকে ধারণ করতে হলে আলাদা ফোকাস করা দরকার। যেখানে তাঁর করে যাওয়া কাজগুলো নিয়ে চর্চা করা হবে। আশা করি, তিনি জাতীয় স্বীকৃতি পাবেন এবং তাঁর রেখে যাওয়া কর্মভার আমরা সামনে অগ্রসর করতে পারব।

জসিম উদ্দীন চৌধুরী

খুব ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, বাবা আদর্শবাদী ছিলেন। কারখানা যখন আধুনিকায়ন করা হচ্ছে, তখন শিল্প ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। জার্মান হাইডেনবার্গের যারা বাংলাদেশে নানা ধরনের মেশিনারিজ পাঠাতেন, তারা একটা কমিশন পেতেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করল, আপনার এই কমিশনটা কী করব আমরা। যেহেতু ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট আসছে, কমিশনটা দেয়, তখন বাবা বললেন ওটা নিয়ে আরেকটা মেশিন দেন। তখন ওখানকার পরিচালক বাবার সাথে দেখা করতে এসেছেন। বললেন, এ কেমন মানুষ! সবাই পয়সা নিয়ে নেয়, আর ওনি আরেকটা মেশিন চাচ্ছেন। এমনই ছিল ওনার আদর্শ। একটা নীতি-আদর্শের মধ্য দিয়েই আমার বাবা ইউসুফ চৌধুরী জীবনটা পার করেছিলেন।

মনে আছে, আমি বিদেশ থেকে ফিরে সিগনেট প্রেস নিয়ে দেখছিলাম যে ব্যবসা আরো বড় করা যায় কিনা। তখন যা খরচ পড়ছে, তাতে কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তখন দেখা যেত অনেকেই দশ টন ঘোষণা দিয়ে ১০০ টন বোর্ড পেপার আনত। এতে শুল্ক কম দিতে হতো। বাড়তিগুলো বাজারে বিক্রি করত। কিন্তু বাবা এটা পছন্দ করতেন না। এই কারণে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিলাম না। ওনি বলতেন, আমরা যদি সরকারকে পয়সা না দিই, তাহলে সরকার কীভাবে উন্নতি করবে? এমনই ছিল তাঁর মনোভাব, এই ছিল তাঁর চিন্তা।

মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী

আমার ম্যাজিস্ট্রেসি জীবনের শুরুতে চট্টগ্রামে ছিলাম। মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সাহেব কর্ণফুলী নদী সুরক্ষা ও বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা নিয়ে আমাকে ফোন দিতেন। চট্টগ্রাম নগরজুড়ে আমরা যে অভিযানগুলো চালাতাম, ওনার আগ্রহ ছিল সেখানে, বন্দরকে ওনি খুবই গুরুত্ব দিতেন। আমাকে টেলিফোন করে বলতেন, ‘অনর নিউজ আইস্যি না?’ সেসময় অনেকগুলো বড় ঘটনা ঘটেছিল। একটি গমের বড় চালান আটক করেছিলাম, ইউক্রেন থেকে ১১ হাজার মেট্রিক টন গম আনা হয়েছিল, পুরোটাই ছিল পচা। অথচ সেই গম কাস্টমস, কৃষি বিভাগ, বিএসটিআই, এটমিক এনার্জি কমিশন সবারই ছাড়পত্র পেয়েছে। এটা আমারও ধরার কথা না, আমার কাজের অংশও না। আমি কর্ণফুলী নদী দিয়ে যাচ্ছিলাম, মোবাইল কোর্টে ছিলাম। দেখলাম, একটা জাহাজ থেকে প্রচ- দুর্গন্ধ আসছিল। ভূমিতে এসে সেই জাহাজে গিয়ে দেখি পচা গম, সবগুলোতে ফাঙ্গাস পড়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ খালাস বন্ধ করে দিলাম, খালাস বন্ধ করার পর সরকারের এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে খুব উচ্চ পর্যায় থেকে খুব হুমকি দেওয়া হল। টেস্টের রেজাল্ট পেলাম। গমগুলো খাওয়ার উপযোগী না, সবগুলো জব্দ করা হল। এমনকি গরুকেও খাওয়ানো যাবে না। তখন অধিকাংশ পত্রিকা এই নিউজ করল না, টেলিফোন আসার পর নিউজ প্রকাশ করেনি কেউ। একমাত্র পূর্বকোণ এই নিউজ প্রকাশ করল। আমি ইউসুফ চৌধুরী সাহেবকে ফোন করেছিলাম, বড় করে নিউজ হলো। সে গম ট্রাকে ট্রাকে বের করে আনন্দবাজার ডাম্পিং ইয়ার্ডে নষ্ট করতে নেওয়া হল। বিরাট একটা সাপোর্ট পেয়েছিলাম পূর্বকোণের।

১৯৮৬ সালে আমি স্টুডেন্ট ছিলাম, আমি দেখে আসছি সেই তখন থেকে এখনও পর্যন্ত পূর্বকোণ পত্রিকা কারো পক্ষে-বিপক্ষে যায়নি। কারো দালালি বা দোসর নীতিতে নেই। এটা অনেক বড় একটা আদর্শ, যে মহৎ স্পিরিট নিয়ে এটার শুভ সূচনা করেছিলেন, ডা. রমিজ সাহেবকে বলব আপনার অনেক বড় শক্তি এই সংবাদপত্র। এখন শক্ত হাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে স্পিরিট সেটা কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নে জোর দিতে হবে। আমি মনে করি চট্টগ্রামে যে দুটি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ইউসুফ চৌধুরী সাহেবের অবদান ছিল, সেই চুয়েট এবং সিভাসুতে ওনার নামে একটি করে চেয়ার স্থাপন করা হোক।

ড. মো. মঞ্জরুল কিবরিয়া

মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সাহেবকে দেখেছি একজন চট্টলদরদী প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে। হালদা নদী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ইতিহাসটা বলি। ২০০১/০২ সালে তখন আমি বিশ^বিদ্যালয়ের প্রায় শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। বিশ^বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে একটা এমফিল ডিগ্রি করছিলাম। সে সময় গড়দুয়ারা এলাকায় হালদা নদীর একটি বাঁক কেটে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। আমি পূর্বকোণ অফিসে এসে সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করি। হালদাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বাঁকগুলো কিন্তু খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ এটি মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এখন বাঁকটা যদি কেটে দেওয়া হয় তাহলে মাছের প্রজনন থাকবে না। আমি বুঝতে পারলাম, এটা বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ হতে যাচ্ছে। তবে স্থানীয় লোকজন হালদাকে ধ্বংস বা মৎস্য প্রজনন নষ্ট করতে এই কাজটা করছেন না। তারা নিজেদের বাড়িঘর রক্ষার জন্য বাঁক কাটছেন। এটি যদি আমি প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে হালদাকে আমরা রক্ষা করতে পারবো না। হালদা শুধু চট্টগ্রামের নয়, বৈশি^ক সম্পদ। সে সময়ে আমাদের পক্ষে তেমন কেউ ছিলেন না। বাঁক কাটার পক্ষেই লোকজন বেশি ছিলেন। তখন আমি এবং মোহাম্মদ আলী সারাদিনের জন্য নৌকা ভাড়া করে বিভিন্ন স্থানে গেলাম। বিভিন্ন বাজারে গিয়ে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে আলাপ করলাম। সবাই বুঝলেন বাঁকটা যদি কেটে দেওয়া হয় এই প্রজনন কেন্দ্র আর থাকবে না। এরপর এ নিয়ে দৈনিক পূর্বকোণে সিরিজ প্রতিবেদন তৈরি করা হল। প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশের দিন আমরা মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। তিনি এ নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন তৈরির জন্য মোহাম্মদ আলীকে উৎসাহিত করলেন। তখন আমি তরুণ গবেষক। তিনি আমাকে আরও বেশি উৎসাহিত করলেন। মূলত সেখান থেকেই শুরু আমার গবেষণা। শুরু হয় আমাদের হালদা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম।
মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর কারণেই আজকে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হালদা বিশ^ব্যাপী স্বীকৃত। এ রকম একজন চট্টল দরদী মানুষ জাতীয় স্বীকৃত না পাওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। যেখানে গুণীর কদর হয় না, সেখানে গুণী জন্মায় না। আমি জোরালোভাবে এর দাবি জানাচ্ছি। দুটি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন, পোল্ট্রি ও ডেইরি শিল্পের উন্নয়ন, হালদা সংরক্ষণ, কর্ণফুলী বাঁচাও এবং পরিবেশ সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওনার ছিল অসামান্য অবদান। আমরা মনে করি ইউসুফ চৌধুরী স্বীকৃতি পেলে স্বনির্ভর চট্টগ্রামও স্বীকৃতি পাবে।

ডা. ম. রমিজ উদ্দীন চৌধুরী

১৯৯৪ সালে আমার বড়ভাই স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার পর তিনি ভাল হয়ে যান। এরপর ২০০৪ সালে তিনি আবারও অসুস্থবোধ করলে ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তখন মেডিকেল কলেজে আমার ব্যক্তিগত কাজ থাকায় আমি বড় ভাইয়ের সঙ্গে যেতে অপারগতা জানাই। কিন্তু আব্বা জানার পর আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন, ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় যাওয়াটা তোমার কাজের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রাধিকার। আব্বার কথামতো ঢাকায় গিয়ে ডাক্তার দেখানোর পর বড় ভাইয়ের পুনরায় অন্য ধরনের ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। সেটা জানার পর তার চিকিৎসা শুরু করা হয়। বড় ভাই দুটি ক্যান্সার নিয়ে ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। যা পৃথিবীতে বিরল। সন্তানের প্রতি পিতার যে দায়িত্ববোধের পরিচয় আমার আব্বা ইউসুফ চৌধুরী দিয়েছেন সেটা আমার স্মৃতিতে এখনও জ্বল জ্বল করছে। এটা আমার জীবনের জন্য একটা শিক্ষাও বটে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর স্মৃতি ধরে রাখতে আমার দুটো প্রস্তাবনা রয়েছে। প্রথমত-ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইবিএ অথবা অর্থনীতি বিভাগে মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী নামে একটা চেয়ার চালু করা এবং অপরটি হল-চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ইউসুফ চৌধুরীর নামে স্মৃতি বৃত্তি। এগুলো করা গেলে ইউসুফ চৌধুরী বেঁচে থাকবেন। শুধু ইউসুফ চৌধুরীর জীবনী নিয়ে একটা বই হওয়া দরকার। বই বের হলে সারাদেশের গণগ্রন্থাগার, জাতীয় গ্রন্থাগার, জাদুঘর, লাইব্রেরিসহ সবখানে বইয়ের কপি দেওয়া যাবে। তাহলে ওনার সম্পর্কে মানুষ আরও বেশি জানতে পারবে।

তিনি যতো বড় মানুষ, ওনার যতো বড় অবদান, ততটা অনালোকিত ও অনালোচিত। পূর্বকোণের প্রতি আমাদের আলাদা একটা দরদ আছে। আমি ইউসুফ চৌধুরীর কাছে অত্যন্ত স্নেহভাজন একজন ছিলাম। তিনি আমাদের ছেলের মতো স্নেহ করতেন। ইউসুফ চৌধুরীর নাম কম প্রচারিত হতে দেখে আমাদের ব্যথা লাগে। পূর্বকোণ সবসময় একটি ভালো পত্রিকা। আঞ্চলিক পত্রিকার মধ্যে পূর্বকোণ এক নম্বরে রয়েছে। ইউসুফ চৌধুরীকে নিয়ে আরও প্রচার বাড়াতে হবে। অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে প্রধান করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে একটা চেয়ার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর সুযোগ্যপুত্র ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরীর ওপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি চাইলে পারবেন।

কবি শিশির দত্ত

মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সাহেবের সাথে একটা দীর্ঘ সময় কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেটা প্রায় চৌদ্দ বছর। ইউসুফ চৌধুরী সাহেবের বিস্তৃতি এবং ব্যাপকতা বিশাল। সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করে এটা সম্পন্ন করা কখনোই সম্ভব নয়। আমি শুধু তাকে নিয়ে করা দুই একজন গুণী মানুষের মন্তব্য বলছি- ড. আনিসুজ্জামান, ইউসুফ চৌধুরীকে মনে করতেন রুচির কারিগর। পূর্বকোণ সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে উনার সাথে দেখা করতে গেলে উনি সবসময়ই এই কমেন্টটা করতেন। চট্টগ্রামে সংবাদপত্র প্রকাশের যে আন্দোলন, এটা সূচনা করেছিলেন ইউসুফ চৌধুরী। চট্টগ্রামের উন্নয়ন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ বিভিন্ন উদাহরণ আমরা দিতে পারি। উনার কর্ম এবং জীবন নিয়ে উপস্থিত বিজ্ঞজন অনেক কিছু বলতে পারবেন আরও বিস্তৃতভাবে। কিন্তু আমি দুঃখের সাথে বলতে পারি এই মানুষটিকে আমরা রাষ্ট্রীয় কোন সম্মান দিতে পারিনি। এবং এই বেদনাবোধ থেকে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি। আমরা কেন এটা পারলাম না? আমাদের ব্যর্থতা কোথায়? স্বনির্ভর চট্টগ্রামের পেছনে যে মানুষটির অনন্য ভূমিকা, তাকে আমরা যথাযথ স্বীকৃতি দিতে পারিনি।

এরজন্য উনার অসংখ্য কাজের মধ্যে শুধুমাত্র হালদা নিয়ে যে অসামান্য উদ্যোগ তা আমরা তুলে ধরতে পারি। আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব উনার অবদানগুলো তুলে আনা। আমি মনে করি পূর্বকোণ অনেকগুলো মাইলস্টোন তৈরি করেছে চট্টগ্রামে। দুটি বিশ^বিদ্যালয়ের নেপথ্যে কারিগর, হালদা নদী রক্ষা, চট্টগ্রামে ডেইরি বা পোল্ট্রি শিল্পে মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর অনন্য অবদান রয়েছে। চট্টগ্রামের যে আলাদা শিক্ষা বোর্ড, এর পেছনেও ভূমিকা আছে ইউসুফ চৌধুরীর।

 

মীর মু. সাক্বী কাওসার

বিআইটি’কে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তর করতে আমরা কমিটি গঠন করে চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম। ২০০১ সালের ১০ জুন আমাদের একটা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে নিয়ে গেলাম ইউসুফ চৌধুরী সাহেবকে। ওনার প্রেরণা ছিল বড় একটা ইতিবাচক ধাক্কা। আমরা প্রথমবার সাংবাদিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম। এটা দৈনিক পূর্বকোণ দিয়েই শুরু হয়েছে। সবক্ষেত্রেই ইউসুফ চৌধুরী সাহেবের অনুপ্রেরণায় আমাদের আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে। এরমধ্যে বিআইটিকে বিশ^বিদ্যালয়ে উন্নীত করার আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষ সবাই যুক্ত হয়েছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চট্টগ্রামের এটি গণদাবিতে পরিণত হল। এটা সম্ভব হয়েছিল ইউসুফ চৌধুরী সাহেবের পরামর্শে। এরপর ২০০৩ সালে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিআইটি চট্টগ্রাম উন্নীত হল বিশ^বিদ্যালয়ে। বিআইটি চট্টগ্রামের আন্দোলনের কারণে দেশের অপর চারটা বিআইটি বিশ^বিদ্যালয় হয়েছে। আমাদের আন্দোলনের কারণে সরকার যখন বিআইটি চট্টগ্রামকে আপগ্রেডেশনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, তখন অন্যান্য বিআইটিগুলোও আন্দোলনে নামে। পরবর্তীতে সবগুলোকে একসঙ্গে বিশ^বিদ্যালয় করা হলো। চট্টগ্রাম যেমন সব কিছুতে নেতৃত্ব দেয়, বলা যায় বিআইটিগুলোকে বিশ^বিদ্যালয়ে রূপান্তরে আমরাই নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। আমাদের অভিভাবক হিসেবে মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সবসময় সক্রিয়ভাবে সঙ্গে ছিলেন। উনি সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন, এরকম একটা মানুষের কারণে চট্টগ্রাম তথা পুরো দেশ লাভবান হয়েছে।

 

ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ ইব্রাহিম

মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী একজন শুধুই ব্যক্তি নন, তিনি সৎ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মতো আদর্শবান ব্যক্তি বর্তমান সমাজে বিরল। আমি যাদের সাথে মিশেছি তাদের মধ্যে ইউসুফ চৌধুরী ব্যতিক্রম। মানবপ্রেমিক হিসেবে তিনি সবার উর্ধ্বে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়নে তার ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। চট্টগ্রামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি মনেপ্রাণে উপলব্ধি করেছিলেন চট্টগ্রামের প্রতি বিমাতাসূলভ আচরণ হয়েছে। ইউসুফ চৌধুরীর অবদান চট্টগ্রামবাসী কোনোদিন ভুলতে পারবে না। ভুলে গেলে বেঈমানি করা হবে। ইউসুফ চৌধুরীকে যদি আমরা স্মরণ না করি তাহলে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের উন্নয়নকে ছোট করা হবে। তিনি ৮৬ বছর বয়সে বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে ৩৯টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন করেছিলেন। প্রতিটি ওয়ার্ডে যখন যেতেন তখন আমি তাঁর সাথে সাথে থাকতাম। এক কথায় স্বনির্ভর চট্টগ্রাম গঠনে ইউসুফ চৌধুরীর ভূমিকা ছিল অনন্য।

 

মাওলানা ওমর ফারুক

বর্তমানে মাংসে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। গরুর দুধের ক্ষেত্রেও প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি। অথচ ১৯৯০ সালের দিকে ফিরে তাকালে দেখি, আমরা কতটুকু পিছিয়ে ছিলাম। এতে দ্রুত সময়ের মধ্যে এ অর্জনের কৃতিত্ব মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর। সে সময়ে প্রান্তিক পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে পশু লালন পালন করা হতো না। শিক্ষিত সমাজে গরু পালন করা সে সময়ে অকল্পনীয় ছিল। টাকা দিয়ে যে খাঁটি দুধ পাওয়া যায় সেটা কল্পনা করা যেত না। ওনি যখন গরু পালনে আগ্রহী হলেন, সাথে সাথে একদল তরুণকে গড়ে তুললেন। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে উৎসাহ দিলেন। সে ধারাবাহিকতায় এটার ব্যাপকতা চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর তাই ইউসুফ চৌধুরীকে দিয়ে স্বনির্ভর চট্টগ্রাম নয়, স্বনির্ভর বাংলাদেশ বলতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গরু পালনের যে রেওয়াজ, এটা ইউসুফ চৌধুরী না হলে সম্ভব হতো না। বিভিন্ন সময়ে এসব বিষয়ে আন্দোলন সংগ্রামে তিনি আমাদের সঙ্গেই থাকতেন।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট