চট্টগ্রাম সোমবার, ২৪ জুন, ২০২৪

চামড়ার সুদিন ফেরাতে প্রয়োজন ৩ উদ্যোগ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৫ জুন, ২০২৪ | ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

পুঁজিসংকট ও পরিবেশগত ছাড়পত্রের অভাবে একে একে বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রামের ট্যানারি শিল্প। হয়ে পড়ে ঢাকামুখী। এরপর থেকে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। ২০১৫ সাল থেকে দুর্দিন যাচ্ছে চামড়াশিল্পে। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রায় ২৫ কোটি টাকার পুঁজি আটকে রয়েছে। পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছেন অন্তত দুই শতাধিক চামড়া আড়তদার-ব্যবসায়ী।

 

ট্যানারি, আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা জানান, তিনটি উদ্যোগই চামড়াশিল্পের সুদিন ফেরাতে পারে। প্রথম হচ্ছে, পরিবেশ দূষণ বন্ধ ও এলডব্লিউজির শর্ত মতে পরিবেশবান্ধব ট্যানারি স্থাপন করা। যাতে ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানি সহজ ও সহায়ক হয়। দ্বিতীয়ত, ট্যানারি ও আড়তদারদের আর্থিক সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে স্বল্প সুদে ঋণসুবিধার উদ্যোগ নেয়া। তৃতীয়ত, সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেওয়া দরে চামড়া বেচাকেনায় সরকারের মনিটরিং করা।

 

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তাদার-ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘বাংলাদেশে মাত্র তিনটি ট্যানারির লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ রয়েছে। এই সনদ না থাকায় ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিশ্ববাজারে বেচাকেনা সীমিত হয়ে পড়েছে। এলডব্লিউজির শর্ত মোতাবেক ইটিপিসহ পরিবেশবান্ধব ট্যানারি স্থাপন করতে হবে। একই সঙ্গে আর্থিক সংকট কাটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধানত এসব উদ্যোগ নিলেই চামড়াশিল্পের হারানো গৌরব অনেকটা ফিরে আসবে।’

 

এক সময়ে চট্টগ্রামে ৩০টি ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। স্বাধীনতার পরেও ২২টি ট্যানারি ছিল। বর্তমানে চালু রয়েছে রিফ লেদার ট্যানারি। এটি চট্টগ্রামের ১০ শতাংশ চামড়া কিনে বলে জানান আড়তদাররা। বাকি ৯০ শতাংশ চামড়া ঢাকার ট্যানারিনির্ভর হয়ে পড়েছে।

 

রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক মোখলেছুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে আরও কয়েকটি ট্যানারি থাকলে চামড়া বেচাকেনায় সুবিধা হতো। শুধু কোরবানি আসলেই এই নিয়ে মাতামাতি হয়। আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার ব্যবহার কমে যাওয়ায় চাহিদাও অনেক কমে গেছে। সিনথেটিক (কৃত্রিম) মেটেরিয়ালের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে।’

 

আড়তদার সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রামে চাহিদা মতো ট্যানারি না থাকায় চামড়া বেচাকেনায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। লোকসান দিতে দিতে অনেক ব্যবসায়ী ফতুর হয়ে গেছেন। চট্টগ্রামে অনেক শিল্প জোন হয়েছে। কিন্তু ট্যানারি শিল্প জোন গড়ে উঠেনি। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে এই শিল্পে আগের মতো সুদিন ফিরে আসবে।’

 

২০১৫ সালে বড় ধরনের ধাক্কা খায় চট্টগ্রামে চামড়া ব্যবসায়ীরা। ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে আটকে যায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা। এখনো সেই টাকা আদায় হয়নি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

 

আড়তদার সমিতির সহ-সভাপতি আবদুল কাদের বলেন, ‘ট্যানারি মালিকদের কাছে এখনো অন্তত ২৫ কোটি টাকার বকেয়া আটকে রয়ে গেছে। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ২৫০-৩০০ আড়তদার-ব্যবসায়ী থেকে কমে এখন ২৫-৩০ জনে ঠেকেছে। অন্যরা দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘এখনো মুখের কথায় চামড়া বেচাকেনা হয়। ট্যানারি মালিকেরা শুধু একটি স্লিপ দেন। তাতে আইনি ভিত্তি না থাকায় বকেয়া পাওনা নিয়ে বছরের পর বছর ঘুরছেন ব্যবসায়ীরা।’

 

গত বুধবার কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন বিষয়ে এক প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চামড়া ব্যবসার সংকটের চিত্র তুলে ধরেন আড়তদাররা।

 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘পুরোনো বকেয়া টাকা আদায় এবং চলতি বছর থেকে চামড়া কেনাবেচায় ডকুমেন্টধারীর বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের বিষয়েও অর্থ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেওয়া হবে।’

 

ট্যানারি মালিকদের দাবি, লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারের দাম পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রক্রিয়াজাত চামড়া বিক্রির ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হচ্ছে চীনের ওপর। বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে অন্তত ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার আয় হারাচ্ছে।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট