এসো হে বৈশাখ এসো এসো/ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক, যাক, যাক/ এসো, এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো।
পুরনো বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি দূর করে নতুন বছরকে বরণের বারতা বহন করে এ গান। তাইতো কবি গানে গানে বাঙালির সবচেয়ে বড় সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষকে আহবান করেন। এরমধ্যে দরজায় কড়া নাড়ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ ১৪৩১। সেই বর্ষবরণের হাওয়া লেগেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। বর্ষবরণের আকর্ষণীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি এরমধ্যে শুরু হয়ে গেছে চারুকলায়। গতবছর এসময় চারুকলার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রঙহীন ছিল বর্ষবরণের আয়োজন। যেকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে সাদাকালো থিমে বরণ করে নতুন বছর। তবে এবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উৎসবমুখোর পরিবেশে নেয়া হচ্ছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। তারমধ্যে বৈশাখ উৎসবে যোগ হয়েছে ঈদের আমেজ। সব মিলিয়ে উৎসবের রঙে রঙিন এবারের পহেলা বৈশাখ।
গত শনিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মেইন গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে শিল্পী রশিদ চৌধুরী আর্ট গ্যালারি। সেখানেই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাতি, হাড়ি, মোরগ, মাছের আকৃতি। পাশেই কাগজে রঙ তুলি দিয়ে সাজানো হচ্ছে বিভিন্ন রকমের মুখোশ। একদল শিক্ষার্থী জলরঙ ও এক্রেলিকে বিভিন্ন আকারে চিত্রকর্ম আঁকছেন। আরেক দল শিক্ষার্থী ব্যস্ত সরাচিত্র নিয়ে। মাটির সরায় নানা রঙে ফুটিয়ে তুলছেন মাছ-ময়ূর-পাখির মুখ, কেউবা আঁকছেন ফুল-লতাপাতাসহ নানা মোটিভ। গ্যালারির এক কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা গেল বাঘ-সিংহ ও পেঁচার মুখোশে রং করে রাখা হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী মাউনবোর্ড দিয়ে ছোট ছোট পাখি বানাচ্ছেন। একইসঙ্গে তাতে রং লাগানো হচ্ছে। সেসঙ্গে রয়েছে হাতপাখা আর চড়কি। শিক্ষার্থীরা দিনভর কাজ করছেন মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের উপকরণ প্রস্তুত করতে।
অন্যদিকে মাঠের একপাশে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা মাছের কাঠামোতে কাগজ লাগাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় চারটি বড় মোটিভ থাকবে। এসবের মধ্যে রয়েছে হাতি, হাড়ি, মোরগ ও ইলিশ মাছ। এছাড়াও তারা তৈরি করছেন হাতপাখা, চড়কিসহ আরও কিছু বৈশাখী অনুষঙ্গ। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম ‘নবতর রূপে করি বাংলায় বন্ধনা’।
বাইরে চারুকলার দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন লোকজ মোটিভে চিরায়ত হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। লাল, সবুজ, কমলা, সাদা বাহারি রঙে করা হচ্ছে এসব চিত্র। উৎসবের বর্ণিল রঙে সেজে উঠেছে পুরো চারুকলার এলাকা।
বাঙালির উৎসবগুলো এমনি রঙিন, কাজ করতে করতে বলছিলেন চারুকলার প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শ্রুতি বড়ুয়া। তিনি বলেন, দিনভর কাজ করছি। কিন্তু ক্লান্তি লাগছে না। বরং দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে কাজ করছি সবাই মিলে। আমাদের প্রাণবন্ত চেষ্টা পুরো আয়োজনকে বর্ণময় করে তোলা।
৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মংজাইদা চাক বাঁশ কাঠের আকৃতি দিয়ে তৈরি করছেন হাতি। আলাপকালে তিনি বলেন, নিখুঁতভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছি হাতিটা। এটি বাংলার ঐতিহ্য। মঙ্গল শোভাযাত্রায় এসব মোটিভ তুলে ধরতে চাই। এখন কাগজে মোড়ানো হচ্ছে। এরপর রঙ করা হবে। ঈদের আগে আগেই সব কাজ শেষ করতে হবে। কারণ ঈদের বন্ধ পড়ে গেলে শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে যাবে। তখন আবার বর্ষবরণের কাজ শেষ করা যাবে না।
বর্ষবরণ আয়োজক কমিটির সদস্য এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থী স্বপনীল ভট্টাচার্য বলেন, এবারের বর্ষবরণের সাথে ঈদের ছুটি আছে। যে কারণে সময় নিয়ে আমরা বর্ষবরণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঈদের ছুটি শেষে শিক্ষার্থীরা আসতে আসতে আর সময় থাকবে না। আশা করছি সুন্দভাবে শেষ হবে এবারের বর্ষবরণ উৎসব।
উল্লেখ্য, বাংলা ১৪১৩ সালে অর্থাৎ ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীরা নববর্ষের বারতা , বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নগরীর সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে ছোট পরিসরে আয়োজন করেছিলেন মঙ্গল শোভাযাত্রার। পরবর্তীতে এ শোভাযাত্রা আয়োজনের ভার নেয় চবি’র চারুকলা ইনস্টিটিউট।
পূর্বকোণ/এসএ