চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিম্নআয়ের মানুষই বেশি ভুক্তভোগী

২৩ মার্চ, ২০২৪ | ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অনুকূল আবহাওয়া ও জলবায়ু রয়েছে। পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক সময়কালের বিভিন্ন যুগে আবহাওয়া ও জলবায়ু প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তিত হয়ে হয়ে বর্তমান হলোসিন সময়কালে এসে মোটামুটি স্থিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, আবহাওয়া ও জলবায়ুর সাম্প্রতিক রূপটিই বিশ্বব্যাপী মানবজাতির ছড়িয়ে পড়া, বসবাস ও সভ্যতা বিকাশের জন্য সর্বাধিক অনুকূল হিসেবে বিবেচিত।

 

কিন্তু আশংকার কথা হচ্ছে, আমাদের চিরচেনা আবহাওয়া ও জলবায়ুর স্বাভাবিক এই রূপটিতে আবারো বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন ঘটতে চলছে। তবে জলবায়ুর সাম্প্রতিককালের এই পরিবর্তন ভূতাত্ত্বিক সময়কালের অন্যান্য যুগসমূহে প্রাকৃতিকভাবে ঘটা জলবায়ুর স্বাভাবিক পরিবর্তন নয়। এই পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে মানবসৃষ্ট নানান কর্মকা-ের পরিণতি হিসেবে। ফলে প্রকৃতি ক্রমশই আগ্রাসী রূপে ধরা দিচ্ছে একের পর এক দুর্যোগ নিয়ে।

 

বিশেষজ্ঞগণ আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং হিসেবে পরিচিত। শিল্প বিপ্লবের পূর্বের তুলনায় পরবর্তী সময়কালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমানো না হলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। যা আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদানগুলোর ভারসাম্যকে এলোমেলো করে দেবে।

 

বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুস্পষ্টরূপে দৃশ্যমান বাংলাদেশেও। শিল্পায়ন প্রক্রিয়া এবং নগরসমূহের দ্রুত ও ব্যাপক সম্প্রসারণ এই প্রভাবকে স্থানীয়ভাবে আরও প্রকট করে তুলছে। এখানে সবুজ ভূমি, জলাশয় ও আবাদি জমি দ্রুত হারে নগরীয় ভূমিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। অপরিকল্পিত এই ভূমি ব্যবহার ও ভূমি আচ্ছাদনের পরিবর্তন দেশের প্রধান প্রধান মহানগরীগুলোতে নানা প্রকার পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের জন্ম দিচ্ছে।

 

সবুজ ভূমি হ্রাস ও জলাশয় ভরাট করে ফেলার মতো অবিবেচনাপ্রসূত মানবীয় কর্মকা- মহানগরীগুলোর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। নগরসমূহের অবকাঠামোগত বিস্তৃতির ফলে অধিকহারে সুউচ্চ ভবন, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য ইট-সিমেন্টের স্তর নির্মাণ হচ্ছে। যা দীর্ঘক্ষণ অধিক তাপ ধরে রাখছে। কমে যাচ্ছে দিন-রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান। এর ফলে মহানগরীগুলো ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে এক একটি তপ্ত দ্বীপে পরিণত হচ্ছে।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রীস্মে দেশে একাধিক তাপদাহ বয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসকল তাপদাহ নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নানান দুর্ভোগের জন্ম দিচ্ছে। স্বচ্ছল জনগণ এয়ার কন্ডিশন, আইপিএস, চার্জার ফ্যান ইত্যাদি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই তাপদাহের সাথে অভিযোজন করতে সক্ষম হলেও সাধারণ নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ অবর্ণনীয় বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে।

 

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহে দিনমজুরি করতে গিয়ে অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে নি¤œ আয়ের মানুষ। কাজের ফাঁকে শরীর জুড়িয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন গাছের ছায়া আর দিঘির পানির শীতল বাতাস। কিন্তু নগরীগুলোতে গাছের ছায়া আর দিঘি কোনোটাই তো আর অবশিষ্ট নেই, গাছ আর দিঘির স্থান দখল করেছে ইট সিমেন্টের আবরণ। নি¤œআয়ের মানুষের দুর্ভোগের এখানেই শেষ নয়, সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বস্তিতে টিনের উত্তপ্ত ঘরে ফিরে বৈদ্যুতিক পাখার সুইচ অন করে দেখে লোডশেডিং চলছে। সারাদিনের তপ্ত দেহ শীতল করতে না পারায় খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে তৃপ্তিভরে ঘুমানো সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় তাদেরকে আবার পরদিন কাজে ছুটে যেতে হয়। দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকার ফলে নিম্নআয়ের মানুষের কর্মশক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের স্বাস্থ্যের ওপর।

স্বাস্থ্যকর ও সবুজ নগরী হিসেবে এককালে খ্যাত চট্টগ্রাম নগর বর্তমানে মহানগরীতে উন্নীত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে এই বিস্তৃতির ফলে মূল্য দিতে হয়েছে মহানগরীর সবুজ উদ্ভিদে মোড়া পাহাড়সমূহ, বনাঞ্চল ও অসংখ্য জলাশয়কে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সবুজ উদ্ভিদের আবরণ (মৎববহ ংঢ়ধপবং) যথাক্রমে ৬৮.৩৪ শতাংশ থেকে কমে ৩৬.৫১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। একই সময়কালে ৫১.৩২ বর্গ কি.মি. সবুজ এলাকা মহানগরীর নঁরষঃ-ঁঢ় এলাকাতে রূপান্তরিত হয়েছে। অপর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাশয়ের পরিমাণ ছিল মোট ভূমির প্রায় ২৩.১৫ শতাংশ যা ২০১৮ সালে কমে ১৬.৪৬ শতাংশে এসে ঠেকেছিল। অবশিষ্ট জলাশয়গুলোও বর্তমানে নগর সম্প্রসারণের ফলে ভরাট হয়ে যাওয়ার হুমকির সম্মুখীন। পাহাড়, সবুজ আর জলাশয় হ্রাসের প্রভাব দৃশ্যমান চট্টগ্রাম মহানগরীর আবহাওয়া ও জলবায়ুতে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফলাফল বলছে- চট্টগ্রাম মহানগরীর ঋতুভিত্তিক সর্বোচ্চ-সর্বনি¤œ এবং গড় তাপমাত্রা সবই বৃদ্ধি পেয়েছে।
নগরীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ধারা অব্যহত থাকলে নি¤œ আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তা সহজেই অনুমেয়। আমাদের মনে রাখতে হবে নি¤œআয়ের জনগণের সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা এই মহানগরীকে সচল রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবসৃষ্ট আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে এখনই সচেতন করা না গেলে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে নগরসমূহ অচিরেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে- এতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ১৩ অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রতিশ্রুতিপূরণে আমরা যতই দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবো টেকসই উন্নয়নের অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণে আমরা ততই সফল হতে সক্ষম হবো।

লেখক:ড. মোহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট